জেলা পর্যায়েও রাজস্ব সংলাপ করা যেতে পারে

হোসাইন মুবারক: অনেক আগে থেকে দেশে বিভিন্ন ধরনের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজস্ব নিয়ে সংলাপ কখনও হয়নি। এ ধারণা একবারে নতুন।

সিলেটে গত ৩ অক্টোবর দিনব্যাপী ‘রাজস্ব সংলাপ’ অনুষ্ঠিত হয়। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ হিসেবে সিলেট কর অঞ্চল আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান। সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মিলনায়তনে ‘আয়কর ক্যাম্প ও করদাতা উদ্বুদ্ধকরণ’ অনুষ্ঠানও হয়েছে।

সিলেটের আয়কর ক্যাম্পে ৩ অক্টোবর কর আদায় হয়েছে ৬৬ লাখ ৩১ হাজার ৭৩ টাকা। আয়কর বিবরণী জমা হয়েছে ৫৯টি ও নতুন করদাতা নিবন্ধিত হয়েছেন ১২৬ জন। এতে ২৮ জন নিবন্ধিত করদাতা প্রধান অতিথির কাছ থেকে করসনদ নেন। অনুষ্ঠানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, সিলেটের কর কমিশনার, পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, মহানগর পুলিশ কমিশনার, সিলেট চেম্বার ও সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বারের নেতা, সাংবাদিকসহ স্থানীয় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

চলতি বছর করের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অংশ হিসেবে এ রাজস্ব সংলাপের সূচনা। রাজস্ব সংলাপের মূল উদ্দেশ্য করযোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে কোনো শঙ্কা-দ্বিধা ছাড়াই কর দিতে এগিয়ে আসে।

এনবিআরের এ পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে শুভ প্রক্রিয়া। গণমানুষের কাছাকাছি গেলে রাজস্ব বিভাগের এ উদ্যোগে তারা সাড়া না দিয়ে পারেন না। কর প্রদানের যোগ্য ব্যক্তি ভীতি ও জড়তা কাটিয়ে এগিয়ে আসতে আগ্রহী হয়। এর সুফল পাওয়া গেছে সিলেটের অনুষ্ঠানে। এনবিআর উদ্যোগী না হলে এবং বিভাগীয় শহরটি সংলাপের আয়োজন না করলে এটি অনুধাবন করা যেত না।

কর কার্যালয় নিত্যদিনের কর্মপ্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর না করে কিছু বিষয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেওয়ার কথা বিবেচনায় নিতে হবে। এতে রাজস্ব অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা আশাতীতভাবে বেড়ে যেতে পারে। সংলাপ ও উদ্বুদ্ধকরণ অনুষ্ঠান ক্রমান্বয়ে বিভাগীয় শহর থেকে জেলা শহর বা উপজেলা শহরগুলোয়ও আয়োজন করা যেতে পারে। ব্যবসাকেন্দ্র ও যেসব এলাকায় অপেক্ষাকৃত বেশি মানুষ কর দেওয়ার সামর্থ্য রাখে, এমন এলাকা চিহ্নিত করেও রাজস্ব সংলাপ আয়োজনের কথা ভাবা যেতে পারে।

প্রতি বছর আমাদের দেশে আয়কর মেলা হয়। এ নতুন ধরনের মেলার উদ্ভব হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে। আগে তো অনেক ধরনের মেলার কথা শোনা গেছেÑবইমেলা, গ্রন্থমেলা, শিল্পমেলা, কৃষিমেলা, বাণিজ্যমেলা ও গ্রামীণমেলা। বিশেষ করে গ্রামীণমেলা মানে আকাশছোঁয়া রঙিন ত্রিপলের নিচে পুতুল নাচ, সার্কাস, যাত্রাগান আর আনন্দ-উৎসবের হইচই। মেলা বলতে অনেকে এতটুকু বোঝেন। তবে আয়কর নিয়ে মেলার কথা শুনে সাধারণ মানুষ প্রথমে হতবাকই হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, এসব মেলায় মানুষ আগ্রহসহকারে অংশ নিয়েছে। এ মেলার ফলে রাজস্ব আদায়ে সাফল্য এসেছে আশাতীত।

অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন কর অফিসে সামান্যসংখ্যক অসৎ কর্মকর্তার অনাকাক্সিক্ষত আচরণের কারণে অনেক করদাতা কর দিতে গিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ওই কর্মকর্তারা নানা রকম প্রশ্ন করে প্রদেয় করের মাত্রা বাড়াতে চান। কথাবার্তার ইঙ্গিতে আইনি ঝামেলার ভীতি প্রদর্শন করেন। এ কারণে অনেক সামর্থ্যবান ব্যক্তি অফিসমুখী হতে ভয় পান। ফলে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। কর অফিসের এমন বিড়ম্বনার কথা নতুন নয়। এ কারণে অনিয়ম কিংবা দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু সরকারি বিভাগের মধ্যে কর বিভাগের নাম চলে আসে। আয়কর মেলা আয়োজনের পর অনিয়ম ও ভয়-ভীতির বাধা ভেঙে দিয়ে করবিভাগ এখন অনেকটা স্বচ্ছ। সাধারণ মানুষের করভীতি কিছুটা হলেও কমেছে; কর বিভাগের প্রতি আস্থা এসেছে। এখন করমেলা মানেই ঝামেলাহীনভাবে কর প্রদানের উৎসব। এখন প্রতি বছরই নভেম্বরে ঘটা করে আয়কর মেলা হয়। মানুষ সোৎসাহে মেলায় অংশ নিয়ে ঝামেলাহীনভাবে কর দিয়ে যায়। এটি ছিল পরিকল্পনাতীত।

রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান সিলেটে আরও নতুন একটি ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি নিয়মিত করদাতাদের আগামী নভেম্বরের আয়কর মেলা থেকে স্মার্টকার্ড দেওয়ার কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে উচ্চ করদাতাদের গাড়িতে ট্যাক্সপেয়ার সংবলিত স্টিকার লাগানোর অধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তারা অফিস-আদালতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবাও পাবেন বলে উল্লেখ করেছেন। এ সিদ্ধান্ত উচ্চ করদাতাদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে। ফলপ্রসূ হতে পারে অন্যান্য স্তরের করদাতার ক্ষেত্রেও।

রাজস্ব বোর্ড কর্তৃপক্ষের এ পরিকল্পনা রাজস্ব আদায়কে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে। এর আগের বছরগুলোয় জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে উচ্চ করদাতাদের তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের পুরস্কৃতও করা হয়েছে। তখন থেকে ওই উদ্যোগ অনেকের মাঝে প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। এ কারণে বছরান্তে কর দিতে অনেকে উদ্বুদ্ধও হচ্ছেন।

সিলেটে যে রাজস্ব সংলাপ হয়ে গেল, তা প্রথম সিলেট থেকে শুরু হয়েছে কি না, তা অবশ্য প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়নি। এ রাজস্ব সংলাপ যে আয়কর মেলার মতো নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করতে পারে, তার পূর্বাভাস সেখানেই পাওয়া গেছে। এ ধরনের রাজস্ব সংলাপ, আয়কর ক্যাম্প, করদাতা উদ্বুদ্বকরণ অনুষ্ঠান ও আয়কর মেলা অব্যাহতভাবে চলতে থাকলে আমাদের রাজস্ব বিভাগ যে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

রাজস্ব দেশের অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করে। রাজস্ব যত বেশি আদায় হবে, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির গতি তত বেশি বেগবান হবে। এজন্য করযোগ্য মানুষকে বেশি করে করের আওতায় আনতে হবে। শক্তিশালী অর্থনীতি মানেই শক্তিশালী দেশ, শক্তিশালী জাতি।

 

গণমাধ্যমকর্মী

mubarokhosen83Ñgmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০