Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 2:14 am

জেসমিনকে গ্রেপ্তারে ‘আইনের ব্যত্যয়’ দেখছে আসক

নিজস্ব প্রতিবেদক: নওগাঁয় র‌্যাবের হেফাজতে মারা যাওয়া সুলতানা জেসমিনকে গ্রেপ্তারে আইনের ‘বড় ধরনের ব্যত্যয়’ হয়েছে বলে মনে করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। ওই নারীর বিরুদ্ধে ‘প্রতারণার’ যে অভিযোগের কথা র‌্যাব বলছে, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে এ মানবাধিকার সংস্থার।

গতকাল বুধবার রাজধানীর লালমাটিয়ায় আসক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নওগাঁর ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠনের সুপারিশ তুলে ধরে বলা হয়, কমিশন গঠন হলে এ মৃত্যুতে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।

লিখিত বক্তব্যের পর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি বলেন, ‘পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসকদের বক্তব্য এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, তাকে (জেসমিন) আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে সংবিধান, বিদ্যমান আইন ও সথাযথ প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটেছে।’

কোথায় আইনের ব্যত্যয়Ñএ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পুরোটাই তো ব্যত্যয়। রাস্তা থেকে তুলে নেয়ার এখতিয়ার কি আছে?’

জেসমিনের বিরুদ্ধে যে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে, তার সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ রয়েছে বলেও আসকের পক্ষ থেকে বলা হয়।

জেসমিনের ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকতকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে কেন র‌্যাব ক্যাম্পে নেয়া হয়েছিল এবং তাকে কী ধরনের বার্তা দিয়েছিল, তা খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেয়া, তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সেই সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের ওপর চাপ প্রয়োগের অভিযোগ খতিয়ে দেখা এবং সরকারের পক্ষ থেকে পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণের দাবি জানানো হয়।

পরিবারের অভিযোগকে ‘অত্যন্ত গুরুতর’ উল্লেখ করে মানবাধিকার সংগঠনটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘এবারই প্রথম এমন অভিযোগ উঠল, তা নয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায়ই নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগ উঠছে। অভিযোগগুলো যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আগের ঘটনাগুলোর আইনগত প্রতিকার না পাওয়ার মধ্য দিয়ে বিচার না হওয়ার যে অপচর্চা বিদ্যমান রয়েছে, তা দূর করা অতীব জরুরি।’

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আবু আহমেদ ফয়জুল কবীর। উপস্থিত ছিলেন নীনা গোস্বামী ও দিলীপ পাল।

গত বুধবার সকালে নওগাঁ সদরের নওযোয়ান মাঠের সামনে থেকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে ৪৫ বছর বয়সী জেসমিনকে তুলে নিয়ে যায় র‌্যাব। শুক্রবার সকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার। জেসমিন নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস সহকারী পদে কর্মরত ছিলেন।

র‌্যাবের দাবি, তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ছিল। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে আটক করা হয়েছিল। তবে স্বজনদের দাবি, ‘নির্যাতনে’ মৃত্যু হয়েছে সেই নারীর।

বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হলে র‌্যাব-৫ রাজশাহীর কোম্পানি কমান্ডার মেজর নাজমুস সাকিব সাংবাদিকদের বলেন, সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে পাওয়া আর্থিক প্রতারণার একটি অভিযোগ রয়েছে। তার ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক টাকা লেনদেনের অভিযোগ ছিল। তার ব্যাংক স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করে আমরা তার সত্যতা পেয়েছি। অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় এলাকা থেকে র‌্যাব হেফাজতে নেয়া হয়।

তিনি বলেন, আটকের পরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দ্রুত তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে রাজশাহী নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এরপর তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে শুক্রবার স্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়।

জেসমিনকে র‌্যাব তুলে নেয়ার পর হাসপাতালে নেয়ার আগে কয়েক ঘণ্টা কোথায় রাখা হয়েছিল, তার তদন্ত দাবি করেছেন তার মামা নাজমুল হক মন্টু।

তিনি বলেন, ‘আমার ভাগ্নি অত্যন্ত সাদামাটা একজন গৃহিণী। তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সুলতানাকে সকাল ১০টায় আটক করা হয়। এরপর বেলা ২টায় তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই চার ঘণ্টা আমার ভাগ্নিকে কোথায় রাখা হয়েছিল, তাকে র‌্যাব ক্যাম্পে বা কোনো থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কি না, তা এখনও আমরা জানি না।’

গত সোমবার হাইকোর্ট এক আদেশে জেসমিনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তলব করে। পাশাপাশি তাকে জিজ্ঞাসাবাদে কোন কোন কর্মকর্তা ছিলেন, তাও আদালতকে জানাতে বলা হয়।

গত মঙ্গলবার বিষয়টি নিয়ে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তরে কর্মরত যুগ্ম সচিব এনামুল হকের অভিযোগে তার উপস্থিতিতেই র‌্যাব নওগাঁর ভূমি অফিসের কর্মী জেসমিনকে আটক করা হয়েছিল। পরে তিনি ‘অসুস্থ হয়ে পড়লে’ তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়।

র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, ফেসবুক আইডি হ্যাক করে দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র প্রতারণা করে আসছিল। যুগ্ম সচিবের নাম ও পদবি ব্যবহার করে চাকরি দেয়ার নাম করে বা কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ আদায় করছিল চক্রটি।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, ‘গত ২২ মার্চ (বুধবার) এনামুল হক র‌্যাবের টহল টিমকে দেখতে পেয়ে অভিযোগ করেন। একটি ধর্তব্য অপরাধ হিসেবে র‌্যাবের কাছে অভিযোগ জানাতেই পারেন তিনি। তখন এনামুল হকসহ তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ওই নারীকে আমরা শনাক্ত করতে সক্ষম হই। এনামুল হকের অভিযোগের ভিত্তিতে তার সম্মুখেই ভূমি অফিসে কর্মরত জেসমিনকে আমরা আটক করি। সেখানে দুজন সাক্ষীও ছিলেন। সাক্ষী ও এলাকার লোকজনের সম্মুখে র‌্যাবের দুই নারী সদস্য জেসমিনকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাক্ষীদের উপস্থিতিতে জেসমিন অকপটে সব স্বীকার করেন।’

জেসমিনের মোবাইল ফোনে এনামুল হকের ফেসবুক আইডি চলমান অবস্থায় পাওয়া যায় বলে দাবি করে র‌্যাব মুখপাত্র বলেন, ‘তার মোবাইলে আমরা সোনালী ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট পাই, যেখানে লাখ লাখ টাকার জমা রশিদের প্রমাণ আমরা পাই। তার মোবাইলে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা লেনদেনের বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।’

কমান্ডার আল মঈন বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তাকে আটক করি। সেখানে সাক্ষীও ছিল। যুগ্ম সচিব এনামুল হকসহ সাক্ষীদের উপস্থিতিতে একটি কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে জেসমিনের মোবাইল থেকে পাওয়া তথ্যগুলো নিয়ে প্রিন্ট করা হয়। আলামত সংগ্রহ শেষে যখন আমরা থানার উদ্দেশে যাচ্ছিলাম মামলা করার জন্য তখন ওই নারী অসুস্থ বোধ করেন। বেলা ১টায় আমরা তাকে নওগাঁ হাসপাতালে নিয়ে যাই। তিনি গাড়ি থেকে নেমে হাসপাতালে যান। সেখানে চিকিৎসকরা তার সঙ্গে কথা বলেন। তার বোন, ফুফু ও চাচাকে ডাকা হয়। এমনকি ভূমি অফিসে তার সহকর্মী ও অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারকেও (ল্যান্ড) ডাকা হয়। তাদের উপস্থিতিতেই তার চিকিৎসা চলছিল। সন্ধ্যার দিকে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে সিটিস্ক্যান করে তার স্ট্রোকের আলামত পাওয়া যায়। এক দিন পর তিনি মারা যান। তার কী কারণে মৃত্যু হয়েছে, সেখানে চিকিৎসকেরা উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি পোস্টমর্টেমেও পাওয়া যাবে।’

সুলতানা জেসমিনের মামা ও নওগাঁ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক মন্টু প্রতারণার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘সে ভূমি অফিসের একজন সামান্য কর্মচারী। এ পর্যন্ত কোনো দিন তার বিরদ্ধে কোনো দুর্নীতি কিংবা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ কেউ করেননি।’