মো. জিল্লুর রহমান: ২০২০ সালের ১৭ অক্টোবর নিউজিল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন জেসিন্ডা কেইট লরেল আরডার্ন। জন্ম ১৯৮০ সালের ২৬ জুলাই। এশিয়া-প্যাসিফিকের গুরুত্বপূর্ণ দেশ নিউজিল্যান্ডের রাজনৈতিক ক্ষমতায় এসেই সবার নজর কাড়েন এই তরুণ নেত্রী।
গত সেপ্টেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে নির্বাচন পিছিয়ে যায়। ভোট গণনায় দেখা গেছে, আরডার্নের দল ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ ন্যাশনাল পার্টির প্রায় দ্বিগুণ বেশি ভোট পেয়েছে। জেসিন্ডা আরডার্নের লেবার পার্টি মোট ভোটের ৪৯ শতাংশ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান বিরোধী দল কনজারভেটিভ ন্যাশনাল পার্টি পেয়েছে ২৭ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ দেশটির ১২০ আসনের মধ্যে ৬৪টি আসনে জয় পেয়েছে লেবার পার্টি।
তিনি ২০০৮ সালে যখন প্রথম নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন, তখন তার বয়স ছিল ৩০ বছর। তিনিই নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে তরুণ এমপি ছিলেন। খুব অল্প বয়সেই পেশাগত দক্ষতা দেখিয়ে সবার নজর কেড়েছিলেন। ২০১১ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর তিনি নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্কের গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তারপর কিছুদিন যুক্তরাজ্যের প্রধানন্ত্রী টনি ব্লেয়ারেরও নীতিনির্ধারক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি ২০০৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব স্কলাসটিক ইয়থ সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে তিনি নিউজিল্যান্ডের লেবার পার্টির নেতৃত্বে চলে আসেন। কেউ কল্পনাও করেনি লেবার পার্টি একসময় ক্ষমতায় যাবে।
২৪ বছর আগে ১৯৯৬ সাল থেকে দেশটিতে মিশ্র সদস্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (এমএমপি) ব্যবস্থা চালুর পর কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তবে জেসিন্ডা আরডার্নের দল লেবার পার্টি এ ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। এমএমপি ব্যবস্থায় ভোটারদের দুটো ভোট দিতে হয়। একটি দিতে হয় পছন্দের দলকে, অন্যটি নির্বাচনী আসনের পছন্দের প্রার্থীকে। এমএমপি ব্যবস্থা চালুর পর এখন পর্যন্ত দলটি সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে। ফলে এবারই প্রথমবারের মতো একক দলের সরকার গঠন করতে পারবেন জেসিন্ডা আরডার্ন।
সারা বিশ্বে প্রথমবারের মতো সবচেয়ে কম ৩৭ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিউজিল্যান্ডের দায়িত্বভার গ্রহণ করে জেসিন্ডা আরডার্ন প্রথমবার গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনামে পরিণত হন। নিউজিল্যান্ডের ১৫০ বছরের ইতিহাসেও তিনি সবচেয়ে কম বয়সী সরকারপ্রধান। দ্বিতীয়বার তিনি সংবাদ শিরোনামে পরিণত হন, যখন তিনি ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় তার সন্তানের জš§দানের জন্য ছয় সপ্তাহের ছুটি গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৮ সালে তিনি একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জš§ দেন এবং প্রায় তিন দশক পর তিনি পূর্ববর্তী রেকর্ড ভাঙেন। এর আগে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ১৯৯০ সালে ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় একটি সন্তান জš§ দিয়েছিলেন।
ক্রাইস্ট চার্চে দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় ৫১ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন এক সংকটপূর্ণ মুহূর্তে যে নেতৃত্বগুণ দেখিয়েছেন, তা বিশ্বব্যাপী বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তিনি সারা বিশ্বে সবচেয়ে প্রশংসিত হন যখন ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ ক্রাইস্ট চার্চের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা বেশ দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেন। তিনি ঘটনার পরপরই নিউজিল্যান্ডের পার্লামেন্ট অধিবেশন আহ্বান করেন এবং মুসলিম কমিউনিটির সঙ্গে সংহতি জানানোর জন্য পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অধিবেশন শুরু করেন। তিনি কালো হিজাব পরিধান করে অধিবেশন উপস্থিত হন, আহতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা জানান এবং অধিবেশনে তিনি ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে বক্তব্য শুরু করেন। তার বক্তব্যে তিনি হামলাকারীর নাম ঘৃণাভরে শুধু প্রত্যাক্ষাণই করেননি, তিনি তার নাম উচ্চারণ করতেও অস্বীকৃতি জানান, যা সারা বিশ্বে বেশ প্রশংসিত হয়। তিনি হামলাকারীকে আইনের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেন এবং তাকে সন্ত্রাসী ও অপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাছাড়া তিনি সন্ত্রাসী হামলার দিনটিকে মুসলিম কমিউনিটির জন্য ‘অন্ধকারতম দিন’ এবং যারা হামলার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন, তাদের তিনি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেছেন। একইসঙ্গে তিনি মুসলিম কমিউনিটিকে সান্ত¡না দেওয়ার জন্য নিউজিল্যান্ডের সব রেডিও ও টেলিভিশন স্টেশনকে কোরআন তেলাওয়াত এবং আজান প্রচারের নির্দেশ দেন। উল্লেখ্য, তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সম্প্রতি ক্রাইস্ট চার্চের সন্ত্রাসী হামলার বিচারের রায় প্রকাশিত হয়েছে।
একজন শক্তিশালী নেতার নেতৃত্বের দক্ষতা তখনই প্রমাণিত হয়, যখন কোনো দুর্যোগ খুব দক্ষতা ও সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দূত এই নেত্রী বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায়ও ছিলেন দারুণ সফল। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছিল, তখন জেসিন্ডা আরডার্ন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিউজিল্যান্ডে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করে সারা বিশ্বে রোল মডেলে পরিণত হয়েছেন। ৫ মে তিনি নিউজিল্যান্ডকে করোনামুক্ত দেশ বলে ঘোষণা করেন। করোনাকালে নাগরিকদের সঙ্গে দ্রুত তথ্য বিনিময় করেছেন, তাদের সহযোগিতায় সক্রিয়ভাবে লকডাউন কার্যকর করেছেন। তিনি তার কর্মীদের ২০ শতাংশ বেতন কমিয়েছেন। যারা কর্মহীন হয়েছিল তাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন। যারা করোনায় সংক্রমিত হয়েছিল, তাদের প্রতি তিনি যে মমত্ববোধ ও সহমর্মিতা দেখিয়েছেন, তা সত্যিই একজন মানবিক নেতার আচরণ হিসেবে সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে।
জাসিন্ডা আরডার্ন বিশ্বে প্রথমবার জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের কক্ষে সন্তান নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। গত বছর নেলসন ম্যান্ডেলা পিস সামিটে অংশ নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হয়েছেন এই নারী। বক্তৃতা দেওয়ার সময় তার সন্তান ছিল জীবনসঙ্গী ক্লার্ক গেফোর্ডের কোলে। তিনি পরমাণুমুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন দেখেন। তিনি ফিলিস্তিন ও ইসরাইল দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সমর্থক এবং অন্যায়ভাবে গাজায় ফিলিস্তিনিদের হত্যায় সোচ্চার প্রবক্তা।
তিনি আগামী এক দশকে নিউজিল্যান্ডে ১০০ কোটি বৃক্ষ রোপণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে তার দেশের সব বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে পরিণত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। তিনি ২০৫০ সালের মধ্যে তার দেশের কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনতে ইচ্ছুক ও এর প্রবল সমর্থক। এ কাজে গতি আনার জন্য তিনি তার সরকারের পক্ষ থেকে ক্লাইমেট চেঞ্জ কমিশন গঠন করেছেন।
তিনি সামাজিক গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, প্রগতিশীল চিন্তা ধারণ করেন এবং একজন রিপাবলিকান ও নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক তার রাজনৈতিক আদর্শ বা হিরো এবং নিউজিল্যান্ডের দরিদ্র শিশু ও গৃহহীনদের জন্য পুঁজিবাদের ব্যর্থতাকে দায়ী হিসেবে মনে করেন।
জাসিন্ডা আরডার্ন শুধু ক্রাইস্ট চার্চের সন্ত্রাসী হামলা কিংবা করোনা মোকাবিলা করেই প্রশংসিত হননি, গত ডিসেম্বরে হোয়াইট আইল্যান্ডের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা তিনি দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছিলেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন ও শিশু দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নিউজিল্যান্ডের সরকার হবে সহানুভূতিশীল। এজন্য তিনি ২০১৮ সালে ‘ফোর্বসের পাওয়ার উইমেনের’ তালিকায় জায়গা করে নেন। তিনি টাইম ম্যাগাজিনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায়ও আছেন। তিনি সত্যিকারভাবে একজন গণতন্ত্রের মডেল, মানবতার মূর্ত প্রতীক।
ব্যাংকার ও ফ্রিল্যান্স লেখক
rbbbp@gmail.com