আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় দ্যুতি ছড়িয়ে চলেছে ঠাকুরগাঁওয়ের শতবর্ষী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়। ১১৩ বছর ধরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে বিদ্যালয়টি। এ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন অনেক শিক্ষার্থী এখন দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। ওই বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিতে অনেকে গর্ববোধ করেন।
বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়। ঠাকুরগাঁও শহরের প্রাণকেন্দ্রে মনোরম পরিবেশে এর অবস্থান। বিদ্যালয়টি শুরুতে ১৮৭৫ সালে সেনুয়া-টাঙ্গন নদীর মিলনস্থলের সন্নিকটে অবস্থিত জমিদার বাড়ির পাশে এমই (মিডিল ইংলিশ) স্কুলরূপে চলার পর ১৯০৪ সালের ১ মার্চ ওই স্থানেই এইচই (হায়ার ইংলিশ) স্কুলে পরিণত হয়।
আলী মোহাম্মদ সরকার উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় রূপে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে দীর্ঘদিন এর সহকারী সেক্রেটারি পদের দায়িত্বে ছিলেন। বিদ্যালয়টিকে এইচই স্কুলে (উচ্চ ইংরেজি স্কুলে) রূপান্তরের ক্ষেত্রে রাজশাহী বিভাগের তদানীন্তন ইন্সপেক্টর অব স্কুলস হল ওয়ার্ড বিশেষভাবে উৎসাহ দেন।
টাঙ্গন নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত মাইনর স্কুলটিতে একটি খড়ের আটচালা ঘর ছিল। উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে পরিণত হওয়ার পর সংলগ্ন জমিদার কাচারির একটি বড় দালান স্কুলের কাজে অনেক দিন ব্যবহƒত হয়। স্থান সংকুলান না হওয়ায় স্কুলটি স্থানান্তরের প্রয়োজন দেখা দেয়। স্থানান্তরের নিমিত্তে বর্ধমানের কুসুম গ্রাম জমিদারির তৎকালীন জমিদার বিবি তৈয়বা খাতুন ১০ বিঘা সাড়ে ১৫ কাঠা জমি দান করেন। ওই জমির ওপর ১৯০৬-০৮ সালের মধ্যে স্কুলের সুদৃশ্য ও সর্ববৃহৎ ভবন (বর্তমান প্রশাসনিক ভবন) নির্মিত হয়। ১৯০৮ সালের ডিসেম্বরে বিদ্যালয়টি বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয়। পরবর্তী সময়ে ওই জমিদারির সুযোগ্য উত্তরাধিকারী সৈয়দ বদরুদ্দোজা আরও ২৫ বিঘা জমি দান করেন। এরপর নতুন হোস্টেল নির্মাণ ও সম্প্রসারণের জন্য আরও এক একর জমি ১৯৬০-৬৩ সালের মধ্যে হুকুমদখল সূত্রে আয়ত্ত করা হয়।
উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়রূপে প্রতিষ্ঠিত হলে এর পরিচালনা পর্ষদে প্রথম প্রেসিডেন্ট (সভাপতি) হন দিনাজপুর জেলার তদানীন্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এফজে জেফরিস। তিনি উচ্চ বিদ্যালয়রূপে প্রতিষ্ঠার আগে এমই স্কুলেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯০৮ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরাই পদাধিকারবলে এ স্কুলের প্রেসিডেন্ট ও ১৯০৪ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত ঠাকুরগাঁওয়ের এসডিও গণপদাধিকারবলে সেক্রেটারি ছিলেন।
১৯১০ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত ঠাকুরগাঁওয়ের এসডিও গণপদাধিকারবলে এ স্কুলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মনোনীত হতেন। ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের এসডিও পদাধিকারবলে এ স্কুলের প্রেসিডেন্ট মনোনীত হতেন। মাঝে ১৯০৪ সালে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মহকুমা ইন্সপেক্টর অব স্কুল আবদুল জব্বার এর সভাপতি হয়েছিলেন।
প্রাদেশিকীকরণের পর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা পদাধিকারবলে সেক্রেটারি মনোনীত হতেন। ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁও মহকুমা জেলায় রূপান্তরিত হলে পদাধিকারবলে জেলা প্রশাসকরা সভাপতি ও স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা সেক্রেটারি মনোনীত হন। এভাবেই চলে আসছে। বর্তমানে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত এটি।
প্রধান শিক্ষক আখতারুজ্জামান সাবু বলেন, আমি এ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। এখন এখানে শিক্ষকতা করছি। এর চেয়ে গর্বের আর কিছু হতে পারে না। বিদ্যালয়টি মানুষ গড়ার কারখানায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সুশীল সমাজ ও দক্ষ জাতি গঠনের লক্ষ্যে সুশিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অন্তর্নিহিত গুণাবলির সার্বিক বিকাশ সাধন, মূল্যবোধ সৃষ্টি ও মানসিক উৎকর্ষের বৃদ্ধি ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমিক আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।
ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. তাফিম ও কাদিমুল ইসলাম জাদু জানান, বাংলাদেশের কয়েকটি পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় একটি। আমি এ স্কুলে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে পেরে গর্ববোধ করি।
ঠাকুরগাঁওয়ের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ শহীদ উজ জামান জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমি ভালো ফল করেছিলাম ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের কারণে। এ বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী এখন দেশচালিকায় অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করছেন।
বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সাজিদ আল রেজা জানায়, জেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পড়তে পেরে আমি গর্বিত। এখান থেকে পাস করে অনেক শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন। আমিও ভালো ফল করে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই। ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী এ.কে. কাফী জানায়, কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে তুমি কোন স্কুলের ছাত্র। তখন সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র বললে খুবই তৃপ্তি পাই। আগামীতে ভালো ফল করে দেশকে জানিয়ে দিতে চাইÑআমি ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র।
১০ বছর ধরে শতভাগ পাস ও দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে সেরা স্থান দখল করে আছে ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়।
ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর আইয়ুব আলী জানান, মানুষ গড়ার কারিগর এ বিদ্যালয়। শত বছর পার হলেও শিক্ষার দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই বিদ্যালয়টি। প্রতি বছর ভালো ফল করছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার মান আরও বাড়ানোর জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতার শেষ নেই।
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক আবদুল আওয়াল জানান, সুনামের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। আশা রাখি এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে।
মো. নাহিদ রেজা, ঠাকুরগাঁও