নিজস্ব প্রতিবেদক:বাংলাদেশের সড়কপথে মোটরযানে ব্যবহৃত জ্বালানির মূল্য থেকে প্রতি লিটার বা ঘনমিটারে এক টাকা করে আদায় করা হবে। আর এ অর্থ দিয়ে গঠন করা হবে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল। সম্প্রতি এ প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়।
সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল বোর্ড বিধিমালার যে খসড়া তৈরি করেছে, সেখানে এই প্রস্তাব রয়েছে। খসড়াটি এখন ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কার্যক্রম চলছে। আগামী অর্থবছর থেকে নতুন এ বিধিমালা কার্যকর করতে চায় সরকার।

তথ্যমতে, ২০১৩ সালে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল বোর্ড আইন গঠন করা হয়। এতদিন আইনটি কার্যকর করা হয়নি। তবে এবার সেই আইনটি কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর আওতায় বিধি তৈরি করা হচ্ছে।
বিধিমালায় আয়ের প্রথম উৎস হিসেবে রয়েছে মোটরযানে ব্যবহৃত জ্বালানি থেকে আদায় করা অর্থ। যেমন মোটরযানে ব্যবহৃত পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, সিএনজি, এলএনজি বা অন্যান্য জ্বালানি থেকে প্রতি লিটার বা ঘনমিটারে এক টাকা করে আদায় করা হবে। যদিও ওই টাকা কি জ্বালানির বর্তমান মূল্য থেকে আদায় করা হবে নাকি দাম বাড়িয়ে আদায় করা হবে, তা বলা হয়নি।
সূত্রমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের সড়ক ও মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ২ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যানুসারে, দেশে মোট নিবন্ধিত মোটরযান রয়েছে ৪৭ লাখ ৮০ হাজার।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এসব যানে প্রতিদিন ৫২ লাখ লিটারের বেশি জ্বালানি তেল আর ১৩ কোটি ৯০ লাখ ঘনমিটার সিএনজি ব্যবহৃত হয়। লিটার বা ইউনিটপ্রতি এক টাকা হিসাবে প্রতিদিন আয় হবে প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা, বছরে প্রায় পাঁচ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশে সড়ক বা মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণে এভাবে জ্বালানির মূল্য থেকে খরচ সংগ্রহ করা হয়। সেসব উদাহরণ দেখেই কর্মকর্তারা বাংলাদেশে এ রকম একটি ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করেছেন।
বিধিমালা অনুসারে, বিভিন্ন খাত থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হবে, তা সড়ক ও মহাসড়ক মেরামতের পাশাপাশি এ কাজে নিয়োজিত কর্মীদের বেতন-ভাতা দেয়া এবং অফিস খরচের জন্যও ব্যয় করা হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে সরকার যে বরাদ্দ দেয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ কারণে নিজস্ব উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের তহবিল থাকলে তা সবার জন্যই ভালো। তবে শুরুতেই যেন তা জনগণের ওপর চাপ তৈরি করা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।
তিনি বলেন, প্রথমে অন্তত তহবিলটি টোল, সারচার্জ, বিআরটিএ’র লাইসেন্স/নিবন্ধন ফি ইত্যাদির টাকা দিয়ে কাজ শুরু করা যেতে পারে। তারপর জনগণ যদি সুফল দেখতে পায়, তখন ভালো সড়কের জন্য বাড়তি অর্থ দিতেও আপত্তি করবে না। কিন্তু শুরুতেই সাধারণ জনগণের ওপর চাপ তৈরি করলে তা নেতিবাচক বার্তা দেবে।
বিধিমালায় জ্বালানির মূল্যের বাইরে আরও কয়েকটি খাত থেকে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে অর্থ আদায়ের প্রস্তাব করেছে তহবিল বোর্ড। এর মধ্যে রয়েছে- ড্রাইভিং লাইসেন্স, মোটরযান নিবন্ধন ফি, ওভারলোডিং ও অন্যান্য জরিমানা, মোটরযানের সিসি, ধরন ও ব্যবহার থেকে আরোপিত চার্জ, অধিদপ্তরের পরিদর্শন বাংলো, সরঞ্জাম থেকে পাওয়া অর্থ, রোড কাটিং বাবদ অর্থ, অনুদান ইত্যাদি। এছাড়া সড়ক বিভাগের অধীন বিভিন্ন সেতুর টোল ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকা সেতুর (বঙ্গবন্ধু সেতু, মুক্তারপুর সেতু, পদ্মা সেতু) টোলের ২৫ শতাংশও নেয়া হবে এ তহবিলে।
এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল মালেক বলেন, বিধিমালাটি মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। সেখানে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হতে পারে, নাও হতে পারে। যদি গ্রহণ করা হয়, তখন ঠিক করা হবে কীভাবে জ্বালানির মূল্য থেকে টাকা কাটা হবে।
তিনি আরও জানান, এক্সপ্রেসওয়েগুলোয় একটি বিশেষ টোল আদায়ের কথাও ভাবা হচ্ছে, যদিও এখনও সে রকম কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। খসড়া প্রস্তাবটি আলোচনার পর চূড়ান্ত করা হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি সেটি ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এটি অনুমোদিত হলে বাংলাদেশের সড়ক ও মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণ এই তহবিলের আওতায় করা হবে।
বিধিমালাটি প্রসঙ্গে ড. শামসুল হক বলেন, ‘দেশে উন্নয়নের একটা অংশ হলো সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ। আমাদের দেশে উন্নয়নের অংশ হিসেবে অনেক রাস্তাঘাট তৈরি হচ্ছে, হয়েছে। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কিছুদিন পরেই সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। রক্ষণাবেক্ষণ করতে যদি দেরি হয়ে যায়, তাহলে ভোগান্তির পাশাপাশি সেটা ঠিক করতে খরচ অনেক বেশি হয়ে যায়। আমাদের দেশে এটা একটা সমস্যা; কারণ অনেক সড়ক ঠিক সময়ে মেরামত করা যায় না। হয়তো রাস্তা তৈরির তহবিল আছে, মেরামতের তহবিল নেই। ফলে এর কম একটি তহবিল অনেক আগে থেকেই দরকার ছিল।’
তিনি জানান, ২০০২ সালে প্রথম এই ধরনের তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু কোন মন্ত্রণালয়ের আওতায় বোর্ড থাকবে, এ নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। শুরুতে ভাবা হয়েছিল, যেকোনো স্থাপনা নির্মাণের সময় মোট ব্যয়ের দুই শতাংশ সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ধরতে হবে। তহবিল গঠনের ক্ষেত্রে সেটাও বিবেচনা করা যায়।
তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, সড়ক নির্মাণ চোখে পড়লেও রক্ষণাবেক্ষণ সবসময় দৃশ্যমান হয় না। যেহেতু এই তহবিলের আকার অনেক বড় হবে, সেখানে যেন কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়েও সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।