ইসমাইল আলী: আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কম দামে জ্বালানি তেল কিনে দেশের বাজারে বেশি দামে বিক্রি। এতে টানা মুনাফা করে যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এর ঠিক বিপরীত চিত্র বিদ্যুৎ খাতে। বেসরকারি খাত থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করায় বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এজন্য পিডিবিকে প্রতি বছর প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ক্রমাগতভাবে বড় অঙ্কের মুনাফা করছে বিপিসি। এতে আট বছরে ৪৮ হাজার ১২২ কোটি টাকা মুনাফা করেছে সংস্থাটি। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে চলতি অর্থবছর সংস্থাটির মুনাফায় ধস নেমেছে। এর পরও গত ২৩ মে পর্যন্ত এক হাজার ২৬৩ কোটি ৭৮ লাখ মুনাফা করেছে বিপিসি।
এদিকে পিডিবি গত দেড় দশকে কখনোই মুনাফা মুখ দেখেনি। তবে বিভিন্ন সময় সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধি পেয়েছে। আর লোকসানের ঘাটতি পূরণে পিডিবিকে ঋণ না হয় ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি অনুযায়ী, আট বছরে এর পরিমাণ ৫৫ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। ঠিক যেন উল্টো পথেই চলছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত।
তথ্যমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত লোকসানে ছিল বিপিসি। তবে ২০১৪-১৫ অর্থবছর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অনেকটাই হ্রাস পায়। এতে বড় অঙ্কের মুনাফা করে সংস্থাটি। এর পরিমাণ ছিল চার হাজার ১২৬ কোটি আট লাখ টাকা। পরের অর্থবছর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও কমে গেলে বিপিসির মুনাফা দ্বিগুণের বেশি হয়। এতে ২০১৫-১৬ অর্থবছর সংস্থাটির মুনাফা দাঁড়ায় ৯ হাজার ৪০ কোটি সাত লাখ টাকা।
২০১৬-১৭ অর্থবছরও উচ্চ মুনাফা করে বিপিসি। সে অর্থবছর সংস্থাটির মুনাফার পরিমাণ ছিল আট হাজার ৬৫৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা। তবে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমানোয় পরের অর্থবছর সংস্থাটির মুনাফা হ্রাস পায়। এতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর বিপিসির মুনাফা দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৬৪৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। আর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কিছুটা বাড়ায় ২০১৮-১৯ অর্থবছর সংস্থাটির মুনাফা আরও কিছুটা কমে দাঁড়ায় চার হাজার ৭৬৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
পরের বছরও সংস্থাটির মুনাফা মোটামুটি একই রকম ছিল। মূলত কভিড সংক্রমণ শুরুর পর বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের ব্যাপক দরপতন হয়। তবে সে সময় দেশে ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি থাকায় জ্বালানি তেলের ব্যবহার অনেক কমে যায়। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছর বিপিসি মুনাফা করে পাঁচ হাজার ৬৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। তেলের দরপতন অব্যাহত থাকায় পরের অর্থবছর আবারও সংস্থাটির মুনাফায় রেকর্ড হয়। এতে ২০২০-২১ অর্থবছর বিপিসি মুনাফা করে ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
এদিকে কভিডের প্রভাব কমতে থাকায় বিশ্বব্যাপী গত বছর শুরুর দিক থেকেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকে। আর গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তা রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছায়। এ সময় বেশি দরে তেল কিনে কম দামে বিক্রি করায় বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে বিপিসি। ফলে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক দফা বাড়ানো হয়। এর পরও এ দুই জ্বালানি তেলে লোকসান গুনতে হচ্ছে বিপিসি’কে। এছাড়া ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েল ও মেরিন ফুয়েলের দাম কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। তবে পেট্রোল ও অকটেনে সামান্য মুনাফা হচ্ছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছর সংস্থাটির মুনাফায় বড় ধরনের ধস নেমেছে।
অপরদিকে বিপিসির ঠিক বিপরীত চিত্র পিডিবির ক্ষেত্রে। সংস্থাটিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর লোকসানের ক্ষতি পোষাতে ভর্তুকি দেয়া হয় আট হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর তা কমে দাঁড়ায় দুই হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছর ভর্তুকি কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছর তিন হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।
২০১৮-১৯ অর্থবছর লোকসান আবার অনেক বেড়ে যায়। এতে সে অর্থবছর সংস্থাটিকে ভর্তুকি দিতে হয় সাত হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছর সাত হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছর আট হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছর মার্চ পর্যন্ত সংস্থাটিকে ১২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। তবে অর্থবছর শেষে তা ১৭-১৮ হাজার কোটি টাকায় ঠেকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।