Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 12:46 pm

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে বন্দরে কনটেইনার পরিবহন বন্ধ

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে পণ্য ও যাত্রীবাহী পরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে ডাকা ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে বন্দরের আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনে। গতকাল বন্দর থেকে বেসরকারি ডিপো এবং ডিপো থেকে বন্দর ইয়ার্ডে পণ্যবাহী একটি কনটেইনার পরিবহন হয়নি। এতে দুদিনে প্রায় সাত হাজার কনটেইনার জমে গেছে। এতে ইয়ার্ডে কনটেইনার স্তূপ জমে ব্যাহত হবে বন্দরের পরিচালন কার্যক্রম। এ কারণে আরেক দফা বাড়তে পারে পণ্যের দাম। তবে জেটিতে জাহাজ থেকে খোলা পণ্য ও কনটেইনার লোড-আনলোড স্বাভাবিক রয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার সকাল থেকে পরিবহন ধর্মঘট শুরুর পর বন্দরের জেটি, ইয়ার্ড ও অফডকে (ডিপো) স্বাভাবিক সরবরাহ কার্যক্রমে ছন্দপতন ঘটে। সারাদিনে ৩০০ একক কনটেইনার সরবরাহ হয়। অন্যদিকে গতকাল বন্দর থেকে একটি কনটেইনারও সরবরাহ হয়নি। অর্থাৎ বন্দর থেকে বেসরকারি ডিপোতে একটি কনটেইনারও পরিবহন হয়নি। ঠিক একইভাবে বেসরকারি ডিপো থেকে বন্দরের একটি কনটেইনারও পরিবহন হয়নি। এতে দুদিনে সাত হাজার কনটেইনার জমেছে। আগেরদিন ২৪ ঘণ্টায় সরবরাহ হয়েছিল চার হাজার ৩৪টি কনটেইনার। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে বন্দর ইয়ার্ড থেকে চার হাজার কনটেইনার ডেলিভারি হয়। আর জাহাজ থেকে আমদানি ও রপ্তানিবাহী মোট সাত হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়। যদিও জেটিতে জাহাজ থেকে খোলা পণ্য ও কনটেইনার লোড-আনলোড স্বাভাবিক রয়েছে।

বন্দরের এনসিটি, সিসিটির অপারেশনের দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তা জানান, জেটি, ইয়ার্ড ও টার্মিনালের অভ্যন্তরীণ কর্মযজ্ঞ স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। জেটির জাহাজগুলোর লোড-আনলোড স্বাভাবিক রয়েছে। তবে আমদানি পণ্য ডেলিভারি শূন্যে ঠেকেছে। তবে অনেক ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লরি পণ্য বা কনটেইনার বোঝাই করে অপেক্ষা করেছে ধর্মঘট প্রত্যাহারের জন্য। অন্যদিকে চট্টগ্রাম কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা বলেন, বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ড, শেড, টার্মিনাল ও ডিপোতে শুল্ক পরিশোধ, কায়িক পরীক্ষাসহ খালাসের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও হাজার হাজার গাড়ি অলস বসে আছে ধর্মঘটের কারণে। ধর্মঘট দীর্ঘায়িত হলে আমদানি-রপ্তানিকারক, বন্দর ব্যবহারকারী, শিল্পোদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যার বিরূপ প্রভাব সরাসরি অর্থনীতিতে পড়বে।

পণ্য পরিবহনের বিষয়ে বেসরকারি কনটেইনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডার মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হলে নেতিবাচক প্রভাব সরাসরি পড়ে পণ্য পরিবহনে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ১৯টি অফডক থেকে যে সাড়ে ৪ হাজার কনটেইনারবাহী গাড়ি বন্দরে চলাচল করত, যা গতকাল পুরোপরি শূন্যতে নেমে এসেছে। আর আগেরদিন কনটেইনার পরিবহন প্রায় ১০ শতাংশ ছিল। আবার বিভিন্ন কারখানা থেকে রপ্তানি পণ্য নিয়ে যেসব ট্রাক-কাভার্ডভ্যান অফডকে আসত তা শূন্যে নেমেছে। এ দুদিনের চাপ কাটাতে কমপক্ষে এক সপ্তাহ লাগবে। বর্তমানে অফডকগুলোয় এখন ৯ হাজার রপ্তানি পণ্যভর্তি কনটেইনার, ৮ হাজার আমদানি পণ্যভর্তি কনটেইনার এবং ৩৫ হাজার খালি কনটেইনার রয়েছে। অর্থাৎ ৭৮ হাজার কনটেইনার রাখার সক্ষমতার মধ্যে ৫২ হাজার কনটেইনার আছে। এ ধর্মঘট যত দ্রুত প্রত্যাহার হবে, ততই অর্থনীতির জন্য ভালো হবে।

এ বিষয়ে ট্রাক-লরি-প্রাইম মুভার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন বলেন, প্রতিদিন পাঁচ হাজারের বেশি ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ঢোকে বন্দরে। জাহাজ বেশি ভিড়লে আরও বেশি পণ্যবাহী গাড়ির প্রয়োজন হয়। কিন্তু ধর্মঘটের কারণে মালিকরা গাড়িগুলো অলস বসিয়ে রাখছে। আমরা শ্রমিকরা দেশের স্বার্থে শ্রম দিতে প্রস্তুত। গত দুদিন আমরা বেকার বসে আছি। আমরা এ ধর্মঘট চাই না।

অন্যদিকে লাইটার জাহাজ মালিকদের সংগঠন ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশিদ খান বলেন, মাদার ভেসেল থেকে লাইটারে পণ্য পবিবহন স্বাভাবিক আছে। তবে লাইটার জাহাজ থেকে ট্রাকে লোড ও আনলোড বন্ধ আছে। এছাড়া আমাদের ৭০টি লাইটার জাহাজ আছে; যা আগামীকাল মিটিংয়ে বরাদ্দ দেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, আজ মন্ত্রণালয়ে মিটিং আছে। মিটিংয়ের পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, গতকাল বন্দর থেকে একটি কনটেইনারও সরবরাহ হয়নি। আগেরদিন মাত্র ৩০০ কনটেইনার সরবরাহ হয়েছিল। অথচ স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন চার হাজার কনটেইনার সরবরাহ হয়। এতে বন্দর ইয়ার্ডে কনটেইনার জমে যাচ্ছে; যা চাপ তৈরি করবে। তবে জেটি, ইয়ার্ড ও টার্মিনালের অভ্যন্তরীণ কর্মযজ্ঞ স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। জেটির জাহাজগুলোর লোড-আনলোড স্বাভাবিক রয়েছে।

অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট নিয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা ছাড়া সরকারের জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে ধীরে ধীরে দাম নির্ধারণ করা উচিত ছিল। যখন আন্তর্জাতিক বাজারের কমবে, তখন দেশের বাজারের দাম কমবে। একইভাবে দাম বাড়লে দেশের বাজারের বাড়বে। অন্যদিকে কোনো আলটিমেটাম ছাড়াই পরিবহন ধর্মঘট কাক্সিক্ষত নয়। আমরা মনে করি, করোনার দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থার পর যখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্তে, ঠিক সে সময়ে এমনটি মেনে নেয়া যায় না। আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সময়ে যৌক্তিক সমাধান আশা করি। নয়তো আমাদের আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রমে সংকট সৃষ্টি হবে। এতে শিল্পকারখানার কাঁচামাল সংকট দেখা দেবে। দেশে নিত্যপণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘœ ঘটবে। যার প্রভাব ভোক্তার ওপর পড়বে। এছাড়া বিশেষ করে পোশাক রপ্তানিতে জটিলতা সৃষ্টি হবে। এমনতিতে আমাদের রেমিট্যান্স আয় কমছে। এসব প্রভাবে তো আরও কমবে। আর বন্দরে অচলাবস্থা তৈরি হলে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে।