ইসমাইল আলী: বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কয়েক বছর ধরে বেড়েই চলেছে। ২০২০-২১ অর্থবছর এ ব্যয় ছিল গড়ে ছয় টাকা ৬১ পয়সা। দুই বছরের ব্যবধানে ২০২২-২৩ অর্থবছর তা বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। এতে গত অর্থবছর গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ১১ টাকা চার পয়সা। চলতি অর্থবছর তা সামান্য কমবে বলে প্রাক্কলন করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তবে আগামী অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ব্যয় আবার বেড়ে যাবে।
গত অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় জ্বালানি ব্যয় কমলেও বেড়ে যাবে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা। নতুন বড় কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসায় ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেড়ে যাচ্ছে এই দুই বছরে। এছাড়া ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা বাড়ছে। কারণ ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় সরাসরি ডলারে অথবা ডলারের বিনিময় হার ধরে টাকায়। ফলে বিনিময় হার যত বাড়বে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ও তত বাড়বে।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল সাত টাকা ১১ পয়সা। চলতি অর্থবছর তা কমে দাঁড়াবে পাঁচ টাকা ৭২ পয়সা এবং আগামী অর্থবছর পাঁচ টাকা ৪৫ পয়সা। তবে ক্যাপাসিটি চার্জের ক্ষেত্রে ঘটবে তার উল্টোটা। ২০২২-২৩ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ ও অন্যান্য ব্যয় ছিল গড়ে তিন টাকা ৯৩ পয়সা। চলতি অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়াবে চার টাকা ৯০ পয়সা এবং আগামী অর্থবছর পাঁচ টাকা ৪৫ পয়সা।
এ হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছর গড় জ্বালানি ব্যয় কমলেও বেড়ে যাবে গড় ক্যাপাসিটি চার্জসহ অন্যান্য ব্যয়। এর মধ্যে দুই বছরের ব্যবধানে ক্যাপাসিটি চার্জ বাড়বে ৫৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। তবে জ্বালানি ব্যয় কমবে ২৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এতে সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় কিছুটা কমে ১০ টাকা ৬২ পয়সা দাঁড়াবে। যদিও আগামী অর্থবছর তা আবার বেড়ে দাঁড়াবে ১১ টাকা ৫৬ পয়সা।
যদিও এর আগের বছরগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল অনেক কম। ২০২১-২২ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল আট টাকা ৮৪ পয়সা। এর মধ্যে গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল পাঁচ টাকা ৩৭ পয়সা এবং গড় ক্যাপাসিটি চার্জ ও অন্যান্য ব্যয় তিন টাকা ৪৭ পয়সা। আর ২০২০-২১ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল ছয় টাকা ৬১ পয়সা। এর মধ্যে গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল তিন টাকা ১৬ পয়সা এবং গড় ক্যাপাসিটি চার্জ ও অন্যান্য ব্যয় তিন টাকা ৪৫ পয়সা।
প্রসঙ্গত, ২০২২-২৩ অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র তিন দশমিক ৬৮ শতাংশ। এতে নিট উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় (আমদানিসহ) ৮৭ হাজার ৪০ গিগাওয়াট ঘণ্টা। তবে চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১০ দশমিক ০৯ ও আগামী অর্থবছর আট দশমিক ৯৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। এতে ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছর নিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৯৫ হাজার ৮০৫ গিগাওয়াট ঘণ্টা এবং এক লাখ চার হাজার ৪২৩ গিগাওয়াট ঘণ্টা।
গত অর্থবছর কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ২৩ দশমিক ১৬ শতাংশ এবং আগামী অর্থবছর ২৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ায় গড় ব্যয় কমে আসবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক কয়লার দাম অনেকটাই কমে এসেছে। এর প্রভাবেও চলতি অর্থবছর ব্যয় কমবে। তবে আগামী অর্থবছর কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে জ্বালানি ব্যয় কিছুটা বাড়বে। পাশাপাশি ডলারের বিনিময় হার বাড়ায় গড় ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে যাবে।
পিডিবির তথ্যমতে, গত অর্থবছর কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় ছিল ১৫ টাকা ২০ পয়সা। এর মধ্যে গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল ১০ টাকা ৭২ পয়সা ও গড় ক্যাপাসিটি চার্জ চার টাকা ৪৭ পয়সা। চলতি অর্থবছর কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় কমে দাঁড়াতে পারে সাড়ে ১৩ টাকা। এর মধ্যে জ্বালানি ব্যয় পড়বে ছয় টাকা ও গড় ক্যাপাসিটি চার্জ সাড়ে সাত টাকা। আর আগামী অর্থবছর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনে গড় ব্যয় কিছুটা বেড়ে দাঁড়াবে ১৫ টাকা ছয় পয়সা। এর মধ্যে সম্ভাব্য জ্বালানি ব্যয় পড়বে আট টাকা ৭৬ পয়সা এবং গড় ক্যাপাসিটি চার্জ ছয় টাকা ৩০ পয়সা।
এদিকে কয়লার উৎপাদন বাড়ায় ফার্নেস অয়েলের কেন্দ্রগুলো বসে থাকবে। এতে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ অনেক বেড়ে যাবে। গত অর্থবছর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ এসেছে ২১ দশমিক ০৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছর তা অনেকখানি কমে দাঁড়াবে সাত দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং আগামী অর্থবছর দুই দশমিক ৪৭ শতাংশ। উৎপাদন কমায় গড় ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। গত অর্থবছর ফার্নেস অয়েলের কেন্দ্রগুলোয় গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ২০ টাকা ৯০ পয়সা। চলতি অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ২৮ টাকা ৫৯ পয়সা এবং আগামী অর্থবছর ৫৩ টাকা ৭৫ পয়সা।
ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অর্থবছর ফার্নেস অয়েলের কেন্দ্রগুলোয় গড় জ্বালানি ব্যয় ছিল ১৬ টাকা ১০ পয়সা ও গড় ক্যাপাসিটি চার্জ চার টাকা ৮০ পয়সা। চলতি অর্থবছর গড় জ্বালানি ব্যয় পড়বে ১৭ টাকা ৪৬ পয়সা ও গড় ক্যাপাসিটি চার্জ ১১ টাকা ১৩ পয়সা। আর আগামী অর্থবছর সম্ভাব্য জ্বালানি ব্যয় পড়বে ১৭ টাকা ২৮ পয়সা। তবে ওই সময় গড় ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে দাঁড়াবে ৩৬ টাকা ৪৭ পয়সা। মূলত ক্যাপাসিটি চার্জের কারণেই গত অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছর ফার্নেস অয়েলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় আড়াই গুণ ছাড়িয়ে যাবে।
অন্যান্য জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর মধ্যে গ্যাসে গত অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল পাঁচ টাকা। চলতি অর্থবছর তা বেড়ে হবে ছয় টাকা ১১ পয়সা এবং আগামী অর্থবছর ছয় টাকা ৭১ পয়সা। ডিজেলে গত অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ৪০ টাকা ৪০ পয়সা। চলতি অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়াবে ৩৭ টাকা ৩০ পয়সা। তবে আগামী অর্থবছর থেকে ডিজেলের কেন্দ্রগুলো আর চলবে না। যদিও এ সময় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করবে। এক্ষেত্রে শুধু স্থায়ী ব্যয় তথা ক্যাপাসিটি চার্জ ও অন্যান্য ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় টাকা ৪৪ পয়সা। তবে জ্বালানি ব্যয় এক্ষেত্রে বিবেচনা করেনি পিডিবি।
এদিকে গত অর্থবছর হাইড্রো পাওয়ারের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল তিন টাকা ৫৫ পয়সা। চলতি অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়াবে দুই টাকা ৭৪ পয়সা এবং আগামী অর্থবছর দুই টাকা ৩৯ পয়সা। অপরদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির (বায়ু, সৌর) বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় গত অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ১৫ টাকা ৭৭ পয়সা। চলতি অর্থবছর তা দাঁড়াবে ১৫ টাকা ৯৭ পয়সা ও আগামী অর্থবছর ১৫ টাকা ৭১ পয়সা। উভয়ক্ষেত্রেই ব্যয়গুলোকে স্থির ব্যয় হিসেবে বিবেচনা করেছে পিডিবি।
অন্যদিকে গত অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে গড় ব্যয় পড়ে সাত টাকা ৮৩ পয়সা। চলতি অর্থবছর তা বেড়ে হবে আট টাকা ১৭ পয়সা এবং আগামী অর্থবছর আট টাকা ৪৭ পয়সা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির পরিমাণ কাছাকাছি থাকলেও দাম পরিশোধ করতে হয় ডলারে। আর ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে ব্যয় বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এর বাইরে গত অর্থবছর ভারতের আদানির গড্ডা কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে গড় ব্যয় পড়েছিল ১৪ টাকা দুই পয়সা। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম কমায় চলতি অর্থবছর আদানির বিদ্যুতের দামও কমে দাঁড়াবে ১৩ টাকা ৫৮ পয়সা। তবে কয়লার দাম আগামী অর্থবছর আবারও কিছুটা বাড়লে আমদানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে গড়ে ১৪ টাকা পাঁচ পয়সা। তবে আদানির বিদ্যুৎ আসার পরিমাণ বাড়ায় আগামীতে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ কিছুটা কমে বলেই প্রাক্কলন করেছে পিডিবি।