আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা:‘কার-ফ্রি সিটিস’ বলতে আক্ষরিক অর্থে একবারে গাড়িমুক্ত শহর বোঝালেও মূলত ‘কার-ফ্রি সিটিস’ একটি স্লোগান। বাস্তবে কার-ফ্রি সিটি (গাড়িমুক্ত শহর) বলতে অযান্ত্রিক যানবাহননির্ভর এবং গণপরিবহননির্ভর যাতায়াতের শহরকে বোঝানো হয়। সত্তরের দশক থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় সারা ইউরোপে গাড়িমুক্ত শহর দিবস আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। বর্তমানেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। চলমান বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের ফলে বাংলাদেশে জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে প্রধানত আমদানি মূল্য এবং বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ প্রভৃতি পরিশোধের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার মজুত রাখতে হয়। তাই এখনই দরকার বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছানো ঠেকানোর লক্ষ্যে এবং জ্বালানি সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে।
সত্তরের দশকে ইউরোপে জ্বালানির তীব্র সংকটের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন শহরে সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখে অযান্ত্রিক বাহন, যেমনÑবাইসাইকেল, রিকশা, রিকশা-ভ্যান ইত্যাদি বাহনকে চলাচলে গুরুত্ব দেয়া হয়। বিশেষ করে পথচারীকে প্রাধান্য দিয়ে, অর্থাৎ পেডেস্ট্রিয়ান ফার্স্ট পলিসি বাস্তবায়নে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল। এছাড়া ওই দেশগুলোয় ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহারকে তিরস্কার করা হয়; পাশাপাশি যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে গণপরিবহন রেল, ট্রাম ও বাস এবং নদীপথে নৌকা ও লঞ্চকে গুরুত্ব দেয়া হয়। মূলত জলবায়ু বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে এবং বায়ুদূষণ কমাতে এখন এই আন্দোলন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের এখন প্রায় চার হাজার শহরে প্রতি বছর ২২ সেপ্টেম্বর এই গাড়িমুক্ত দিবসটি পালিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশেও ২০০৬ সাল থেকে বেশ কিছু সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে গাড়িমুক্ত শহর দিবস আন্দোলন শুরু করে। যদিও এখন পর্যন্ত তারা দৃশ্যমান সফলতা পাননি। তবে আশার কথা হলো, সরকারি কয়েকটি সংস্থা ওই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ২০১৬ সাল থেকে ঢাকা শহরেও সরকারি উদ্যোগে ‘গাড়িমুক্ত শহর’ দিবস পালিত হয়ে আসছে এবং সরকারি সংস্থাগুলো আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার ফলে ঢাকা মহানগরের তিনটি স্থানে এখন গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হয়, যা কার-ফ্রি স্ট্রিট বা গাড়িমুক্ত সড়ক হিসেবে এরই মধ্যে পরিচিতি লাভ করেছে।
বর্তমান সময়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জীবাশ্ম জ্বালানির দাম বেড়েছে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তাই পৃথিবীর অনেক দেশে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে পৃথিবী জুড়ে দেখা দিয়েছে প্রচণ্ড দাবদাহ ও দাবানল বিশেষ করে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি। বাংলাদেশ যেহেতু জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানিনির্ভর রাষ্ট্র। তাই এই জ্বালানির আমদানি কমিয়ে আনা, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ কমানো এবং যাতায়াত ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার সময় এখনই। জ্বালানি আমদানি প্রতিবন্ধকতার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কারণে লোডশেডিং বাড়ছে। ঢাকা শহরের বর্তমান বাস্তবতায় গাড়িমুক্ত শহর আন্দোলন জ্বালানি সংকট, তীব্র যানজট ও বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পেতে একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। কারণ ঢাকা শহরে আয়তনের তুলনায় মানুষ অনেক বেশি। শহর ও এর আশেপাশে গাছপালা বা বনভূমিও তেমন একটা নেই। শহরে মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার প্রতিদিন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তীব্র যানজট পরিলক্ষিত হয়।
যানজট ও বায়ুদূষণ ঢাকা শহরের জন্য ক্যানসারের মতো রূপ নিয়েছে। এই তীব্র যানজটের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি অপচয় হচ্ছে লাখ লাখ কর্মঘণ্টা এবং পুড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানি। ফলে বায়ু দূষিত হওয়ার কারণে মানুষ অনেক ধরনের অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে এবং বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হয়েছে। যানজটের কারণে রাস্তায় আটকে পড়ে মারা যাচ্ছে অসুস্থ রোগী। এটা যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। এই শহরে যেন জীবনের কোনো মূল্য নেই।
ঢাকা মহানগরে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ গাড়িতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। ফলে বিগত কয়েক বছরে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। প্রতিবছরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। মহানগরের বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায় সব নাগরিক সুবিধা পাওয়ার আশায় এবং মানুষ জীবনজীবিকার জন্য শহরে স্রোতের বেগে ছুটে আসছে। অনেকে জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে পূর্বপুরুষের ভিটামাটি ও গ্রাম ছেড়ে নগরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। এই শহরে ২০ বছরে মানুষ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ছয় লাখ নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে ঢাকা শহরে এবং প্রতিদিন নতুন এক হাজার ৭০০ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। ফলে শহরে জীবনযাত্রায় ও যাতায়াতের ক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। জীবাশ্ম জ্বালানির অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে প্রাণ-প্রকৃতি হুমকির সম্মুখীন। এর অন্যতম প্রধান কারণ তেল, কয়লা ও গ্যাসের ব্যবহার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাওয়া। জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে কার্বন নিঃসরণের কারণে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় জলবায়ু বিপর্যয় ঘটছে। ফলে হুমকির মধ্যে পড়ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
আমরা যদি অযান্ত্রিক যানবাহন ব্যবহার করে যাতায়াত করি, তাহলে শহরে এত বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ থাকত না। এজন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অযান্ত্রিক যানবাহন (বাইসাইকেল, রিকশা, ভ্যান প্রভৃতি) চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট ও আলাদা আলাদা লেন করে দিতে হবে। অনেক পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠন অনেক বছর থেকে অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা লেন করা ও ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনতে আইন ও নীতিমালা করতে বলে আসছে। এছাড়া দূরপাল্লার যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে গণপরিবহন রেল, ট্রাম ও বাস এবং নদীপথে নৌকা ও লঞ্চকে গুরুত্ব দিয়ে যাতায়াত নিশ্চিত করা হলে তীব্র যানজট ও বায়ুদূষণ অনেকাংশে কমে আসবে। কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষ এই বিষয়গুলো বাস্তবায়নে তেমন দৃশ্যমান ও কার্যকর গুরুত্ব দিচ্ছে না। যানজট হ্রাসে ও বায়ুদূষণ কমাতে এবং জলবায়ু বিপর্যয় প্রতিরোধে এরই মধ্যে পৃথিবীর অনেক দেশ যাতায়াতের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে, যার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে লুক্সেমবার্গ ও সিঙ্গাপুর।
এছাড়া বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে, যেমন ইতালির ভেনিস শহর পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। সম্পূর্ণ শহরটিকে ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত করা হয়েছে কেবল বাসস্টপ ব্যতীত। নিউইয়র্কের রজভেল্ট দ্বীপের প্রায় পুরোটাই ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত। নেদারল্যান্ডসের গিথহর্ন শহর ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত হয়েছে। ২০০০ সালে কলম্বিয়ার বোগোতা শহরের মেয়র এনরিক পেনালোসার উদ্যোগে শহরের সর্বপ্রথম কার-ফ্রি ডে পালন করা হয়। রুয়ান্ডার রাজধানী কিলগিতে প্রতি শনিবার ও রোববার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আর্য়াসের অধিকাংশ সড়কই হাঁটার উপযোগী। ফাজিলকা ভারতের প্রথম গাড়িমুক্ত শহর। ২০০৮ সালে এ বাণিজ্যিক এলাকাটি গাড়িমুক্ত শহরের মর্যাদা লাভ করে। হংকংয়ের ডিসকভারি বে’র সড়ক সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত। নেপালের ভক্তপুর শহর ইউনেস্কোর একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। প্রতি রোববার সকাল ৬টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা শহরের কিছু এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে। এ কারণে গাড়িমুক্ত থাকায় এ দিনটি তাদের কাছে হয়ে ওঠে দারুণ উপভোগ্য। হাজার হাজার মানুষ এ দিনটি হাঁটা, সাইকেল চালানো, স্কেটিং, অবসর যাপন, খাওয়া-দাওয়াসহ বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে উপভোগ করেন। মূলত এ দিনটি দূষণ হ্রাসের জন্য পালন করা শুরু হয়। কিন্তু এ দিনটি বর্তমানে জাকার্তাবাসীর জন্য একটি আনন্দময় দিনে পরিণত হয়েছে। নগরবাসী এদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সামাজিকীকরণের এ অনবদ্য আয়োজনে একজোট হন। আমরা যদি ‘গাড়িমুক্ত শহর’-এর এই আন্দোলনকে সম্মিলিত ও সমন্বিতভাবে আরও সামনে এগিয়ে নিতে পারি, তাহলে ঢাকা মহানগরে বায়ুদূষণ, শব্দদুষণ এবং যানজট সহনীয় পর্যায়ে আসবে এবং জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতাও কমে আসবে। তখন রাজধানী মানুষ বসবাসের উপযোগী শহরে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
আইনজীবী
masumbillahlaw06@gmail.com