Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 8:33 pm

ঝুঁকির সমাজে যোগাযোগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

ড. মতিউর রহমান : জার্মানির সমাজবিজ্ঞানী উলরিখ বেকের ‘ঝুঁকির সমাজ’ বা ‘রিস্ক সোসাইটি’ তত্ত্ব আধুনিক সমাজের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার ধারণা নিয়ে আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি স্থাপন করে। উলরিখ বেক ১৯৮৬ সালে তার বই ‘রিস্ক সোসাইটি: টুওয়ার্ডস আ নিউ মডার্নিটি’ প্রকাশের মাধ্যমে এই ধারণাটি জনপ্রিয় করেন। তার মতে, ঝুঁকির সমাজ একটি নতুন ধরনের সমাজ যেখানে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা আধুনিক জীবনের মূল উপাদান হয়ে ওঠে এবং এই ঝুঁকিগুলো প্রায়ই মানুষের কর্ম ও সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয়।
বেক তার তত্ত্বের মাধ্যমে সমকালীন সমাজের পরিবর্তনশীল প্রকৃতি এবং ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার নতুন রূপগুলো নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছেন। বেকের মতে, আধুনিক সমাজ একটি ‘ঝুঁকির সমাজ’ হিসেবে গড়ে উঠেছে, যেখানে প্রযুক্তিগত ও পরিবেশগত ঝুঁকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা কীভাবে সমাজকে প্রভাবিত করে এবং আমরা কীভাবে তা মোকাবিলা করতে পারি, তা বেকের তত্ত্বের মূল বিষয়বস্তু।

বেকের ঝুঁকির সমাজতত্ত্বটি মূলত দুটি প্রধান ধারণার ওপর নির্ভরশীলÑআধুনিকতার ঝুঁকি এবং দ্বিতীয়ত, আধুনিকতা। প্রথম ধারণাটি হলো, আধুনিক শিল্পসমাজগুলো নতুন ধরনের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে, যা প্রথাগত সমাজে অজানা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, পারমাণবিক বিপর্যয়, পরিবেশ দূষণ ও প্রযুক্তিগত বিপর্যয়গুলো এমন ঝুঁকি, যা আধুনিক শিল্পায়নের ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয়েছে। বেক যুক্তি দেন, এই ঝুঁকিগুলো স্থানীয় বা জাতীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে এবং এখন বৈশ্বিক মাত্রায় পরিণত হয়েছে, যা তাদের মোকাবিলা করা আরও কঠিন করে তুলেছে।

দ্বিতীয় ধারণাটি হলো দ্বিতীয় আধুনিকতা, যা মূলত একটি সমাজের পরিবর্তনের প্রক্রিয়া বোঝায়, যেখানে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এই প্রক্রিয়ায়, প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন রাষ্ট্র, পরিবার ও কর্মস্থল তাদের পুরোনো কাঠামোতে টিকে থাকতে পারে না এবং নতুন ধরনের সমস্যা ও ঝুঁকির মোকাবিলা করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। বেক বলেন, এই পরিবর্তনের ফলে সমাজে একটি নতুন ধরনের সচেতনতা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

বেকের তত্ত্ব অনুযায়ী, ঝুঁকির সমাজে জনগণকে নিরন্তর ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হয়। এই ঝুঁকিগুলো কেবল প্রযুক্তিগত ও পরিবেশগত নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। উদাহরণস্বরূপ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এমন ঝুঁকি, যা মানুষকে প্রতিনিয়ত উদ্বেগের মধ্যে রাখে। বেক যুক্তি দেন, এই ঝুঁকিগুলো ব্যক্তিগত জীবন ও সামাজিক কাঠামোর মধ্যে গভীর প্রভাব ফেলে এবং একে অপরকে শক্তিশালী করে।

বেকের ঝুঁকির সমাজতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ঝুঁকি যোগাযোগ এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা। তিনি বলেন, ঝুঁকির সমাজে যোগাযোগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ঝুঁকির ধারণা ও উপলব্ধিকে প্রভাবিত করে। গণমাধ্যম ও অন্যান্য তথ্যপ্রযুক্তি ঝুঁকির তথ্য প্রচারে প্রধান ভূমিকা পালন করে এবং এটি সমাজের ঝুঁকি উপলব্ধি ও প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। তাই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, তথ্যের প্রাপ্যতা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।

উলরিখ বেকের ঝুঁকির সমাজতত্ত্ব আজকের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি, প্রযুক্তিগত বিপর্যয়, যুদ্ধ, সংঘাত ও অর্থনৈতিক সংকটের মতো বৈশ্বিক ঝুঁকিগুলো আমাদেরকে প্রমাণ করে যে, আমরা একটি ঝুঁকিপূর্ণ সমাজে বাস করছি। এই ঝুঁকিগুলো স্থানীয় বা জাতীয় স্তরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বৈশ্বিক মাত্রায় প্রসারিত হয়েছে, যা তাদের মোকাবিলা করা আরও জটিল করে তুলেছে। তাই বেকের তত্ত্ব আমাদের একটি নতুন দৃষ্টিকোণ প্রদান করে, যা ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় একটি সমন্বিত ও বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করে।

উলরিখ বেকের ঝুঁকির সমাজতত্ত্ব আধুনিক সমাজের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার নতুন রূপগুলো চিহ্নিত করে, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রক্রিয়ায় নানাবিধ ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক সামনে আসে।

প্রথমত, পরিবেশগত ঝুঁকি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত। ঘনঘন বন্যা, তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় এলাকা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে জীবিকা হারানো, জনসংখ্যার স্থানান্তর ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উলরিখ বেকের ঝুঁকির সমাজতত্ত্ব অনুসারে, এই ধরনের ঝুঁকি কেবল প্রাকৃতিক নয়, বরং মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলেও সৃষ্ট। বাংলাদেশের দ্রুত নগরায়ণ ও অপরিকল্পিত শিল্পায়নের কারণে পরিবেশ দূষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা পরিবেশগত ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলছে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা জনগণের মধ্যে উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে। শহরের দ্রুত সম্প্রসারণ এবং গ্রাম থেকে শহরে মানুষের প্রবাহ সামাজিক কাঠামোতে পরিবর্তন এনেছে, যা পরিবার ও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী সমর্থন ব্যবস্থা দুর্বল করেছে। বেকের তত্ত্ব অনুসারে, এ ধরনের সামাজিক পরিবর্তন ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মাত্রা বৃদ্ধি করে, যা সমাজের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতেও ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা দেখা যায়। কভিড-১৯ মহামারির মতো বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোকে সামনে এনেছে। চিকিৎসাসেবা ও স্বাস্থ্যসম্মত পানির অভাব, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবের কারণে মহামারির সময় দেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়। বেকের তত্ত্ব অনুসারে, এ ধরনের স্বাস্থ্য সংকট কেবল ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, বরং সামগ্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিও বৃদ্ধি করে।

উপরন্তু, প্রযুক্তিগত ঝুঁকিও বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্রুত সম্প্রসারণ ও ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার যেমন সুবিধা নিয়ে এসেছে, তেমনি সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি ও তথ্য গোপনীয়তার সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের অনেক সংস্থা ও ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবস্থাপনা নিরাপত্তার অভাবে সাইবার আক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। বেকের তত্ত্ব অনুসারে, প্রযুক্তিগত ঝুঁকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠছে এবং এই ঝুঁকির মোকাবিলায় সচেতনতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা বৃদ্ধি করা জরুরি।
প্রতিকার হিসেবে, উলরিখ বেকের ঝুঁকির সমাজতত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু সুপারিশ করা যেতে পারে। প্রথমত, পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলায় টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ করা জরুরি। পরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমাতে সমাজে সমতা ও সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। শিক্ষা ও কর্মসংস্থান ব্যবস্থা উন্নত করা এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা উচিত। তৃতীয়ত, স্বাস্থ্য খাতের ঝুঁকি মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। চতুর্থত, প্রযুক্তিগত ঝুঁকি মোকাবিলায় সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করা এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

উলরিখ বেকের ঝুঁকির সমাজতত্ত্ব বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। এই তত্ত্ব আমাদের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার বিভিন্ন দিক এবং সেগুলো মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে সচেতন করে। ঝুঁকি মোকাবিলায় সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল, নিরাপদ ও টেকসই সমাজ গড়ে তুলতে পারে।

উলরিখ বেকের ঝুঁকির সমাজতত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাজবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা আধুনিক সমাজের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করে। তার তত্ত্ব আমাদের এই ঝুঁকিগুলোর প্রকৃতি এবং তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে সহায়তা করে।
বেকের মতে, এই ঝুঁকিগুলো মোকাবিলা করার জন্য একটি সমন্বিত, বৈশ্বিক ও স্বচ্ছ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তার তত্ত্ব বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং আমাদের একটি নতুন দৃষ্টিকোণ প্রদান করে, যা একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে সহায়ক।