Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:14 pm

ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন নির্মাণ শ্রমিকরা

রবিউল আউয়াল রবি, ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহ বিভাগ হওয়ার পর থেকে মহানগরীতে একের পর এক বহুতল ভবন নির্মাণ বেড়েছে ব্যাপকহারে। এখনও আবাসিক ও বাণিজ্যিক মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। এসব ভবনের নির্মাণ শ্রমিকরা দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। দুর্ঘটনা এড়াতে তাদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নেই কোনো হেলমেট, বেল্ট, অ্যাপ্রোন, গামবুট বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটছে। আহত হচ্ছে নির্মাণশ্রমিক। এদিকে ভবন নির্মাণে সেন্টারিংয়ে এখনও ব্যবহার করা হয় বাঁশ ও কাঠ।

এসব ভবনে রাজমিস্ত্রি ও সাধারণ নির্মাণ শ্রমিক মিলে প্রতিদিন ৩৫০ শ্রমিক কাজ করছে বলে জানা গেছে। ব্যক্তিমালিকানায় ভবনগুলো নির্মাণে একজন হেডমিস্ত্রির অধীন ১০ থেকে ১৫ জন করে সাধারণ রাজমিস্ত্রি ও জোগালি কাজ করে থাকে। এছাড়া সরকারি বেশিরভাগ ভবনের ঠিকাদার স্থানীয় রাজমিস্ত্রি ও নির্মাণ শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করান।

সরেজমিনে নির্মাণাধীন ভবনগুলোয় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে নির্মাণ শ্রমিকদের কারও মাথায় হেলমেট নেই। নেই গামবুট। থাকছে না বেল্ট আর হ্যান্ডগ্লাভস। এছাড়া ভবনের বাইরে লোহার এংগেল ও টিনের আড়ে দাঁড়িয়ে শ্রমিকরা প্লাস্টারের কাজ করছেন। বিল্ডিং কোড আইনে যে কোনো ভবন নির্মাণে কাজের সময় শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে রাজমিস্ত্রি ও সাধারণ শ্রমিকদের মাথায় হেলমেট, বেল্ট ও গামবুট ব্যবহার বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি পোশাকের বেলায় শ্রমিকদের অ্যাপ্রোন ব্যবহার করতে হবে।

বেশ কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা জানে এসব ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু জানলেও কিছু করার নেই। কারণ মালিকপক্ষ সরবরাহ করে না। আর ভবন নির্মাণে কোন কাজটি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তা তাদের জানা নেই।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ভবন নির্মাণে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। নির্মাণ শ্রমিকরা হেলমেট, বুট ও সঠিক পোশাক ব্যবহার করলে দুর্ঘটনা অনেকটা এড়ানো সম্ভব হবে।

ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্রে জানা গেছে, জেলায় নির্মাণ শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার এবং জেলার বাইরে থেকে আসা শ্রমিক প্রায় এক হাজার। এরা দীর্ঘদিন ধরে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ করে আসছে।

জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুযায়ী বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কাজের সময় শ্রমিকের হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক। যারা কংক্রিটের কাজে যুক্ত তাদের হাতে হ্যান্ডগ্লাভস পরতে হবে। চোখের জন্য ক্ষতিকর কাজ যেমন ড্রিলিং, ওয়েল্ডিং, ঢালাইয়ের সময় চশমা ব্যবহার বাধ্যতামূলক। ওয়েল্ডার ও গ্যাস কাটার ব্যবহারের সময় রক্ষামূলক সরঞ্জাম যেমন গ্লাভস, নিরাপত্তা বুট ও অ্যাপ্রোন ব্যবহার করতে হবে। ভবনের ওপর কাজ করার সময় শ্রমিকের নিরাপত্তায় বেল্ট ব্যবহারও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বিল্ডিং কোডে।

তবে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ জায়গায় উপেক্ষিত রয়েছে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি। এছাড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে শ্রমিকদের। ভবন নির্মাণে জাতীয় নির্মাণ বিধিমালা (ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড) মানা না হলেও তা দেখার কেউ নেই।

নির্মাণ শ্রমিকদের রাজমিস্ত্রি জোগানদার সামাদ মিয়া বলেন, পেটের দায়ে আমাদের কাজ করতে হয়। মৃত্যুভয় থাকলে বাড়িতে বসে থাকতে হবে। তিনি বলেন, কনট্রাক্টর দড়ি আর বাঁশ দিয়ে বলেন, ‘মাচা বানিয়ে কাজ করো।’ আমাদের নিরাপত্তায় আর কিছুই দেয়া হয় না।

নগরীর নতু বাজারে একটি নির্মাণাধীন বহুতল ভবনে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচতলায় রড বাঁধাইয়ের কাজ করছেন তিন শ্রমিক। ছাদের একেবারে প্রান্তে দাঁড়িয়ে কাজ করলেও তাদের কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই।

শ্রম আইন অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়োগকারীর। শ্রমিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষা যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা ছাড়া নিয়োগকারী কাউকে কাজে নিয়োগ করতে পারবেন না। কিন্তু নগরীর অভিজাত ও কিংবা জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে বা ব্যক্তিগত মালিকানায় ভবন তৈরিতে নির্মাণ শ্রমিকদের কোনো নিরাপত্তা নেই। ঝুঁকিপূর্ণভাবে দড়িতে ঝুলে বিল্ডিংয়ের রং, পাইপ লাগানোসহ নানা কাজ করতে দেখা গেছে।

তবে ভবন নির্মাণকারী একাধিক মালিক ও ঠিকাদার শ্রমিকদের এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হয় বলেই অন্যান্য খাতের তুলনায় নির্মাণ খাতে দুর্ঘটনার হার কম।

জেলা নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি বাবুল ফকির শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে বারবার ভবন মালিকদের বলেছি, কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথা রাখেনি।

শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক বুলবুল আহমেদ শেয়ার বিজকে জানান, আমরা নির্মাণ সেক্টরে এখনো সেভাবে কাজ করতে পারিনি। তবে আইনগতভাবে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রত্যেক নির্মাতার দায়িত্ব।

শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম খাইরুল শেয়ার বিজকে বলেন, মহানগরীতে বেশিরভাগ ভবন মালিক বা আবাসন ব্যবসায়ীরা বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ করছে। তারা নির্মাণ শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি থেকে শুরু করে নিরাপত্তার বিষয়েও অনিয়ম করছে।

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের (মসিক) মেয়র মো. ইকরামুল হক টিটু শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা ভবনের নকশা অনুমোদনের সময় ভবন মালিক বা নির্মাতাদের বলে দিই, তারা যেন শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। ভবন মালিক বা ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সচেতন হয়ে শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তারা সচেতন না হলে এটা আইন প্রয়োগ করে নিশ্চিত করা কঠিন। আমাদের কাছে এ বিষয়ে কেউ কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এখনও দেয়নি। তাই এ বিষয়ে আমরা কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করিনি।

ভবননির্মাণের তদারকির দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদ আহসান শেয়ার বিজকে জানান, নকশা অনুমোদনের সময় মূলত আমরা ভবন মালিকদের নির্দেশনা দিয়ে থাকি, ‘তারা যেন শ্রমিকদের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।’

বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কমিটির (বিসি) সভাপতি ডিসি মো. এনামুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, বহুতল ভবনগুলোয় শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে গণপূর্তকে দায়িত্ব দেয়া আছে, তারা ভবন মালিকদের সঙ্গে কথা বলবে। প্রয়োজনে নির্মাণাধীন ভবনগুলো পরিদর্শন করে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলবেন এবং মালিকদের শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর নির্দেশনা দেবেন।