মো. শফীকুল আলম : পুঁজিবাজারের মূল চালিকাশক্তি হলেন বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের যথাযথ ব্যবহার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বিনিয়োগ শিক্ষা একটি অপরিহার্য বিষয়। আর বর্তমানে বিভিন্ন দেশ বিনিয়োগ শিক্ষার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করছে। এ উপলক্ষেই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রকদের বৈশ্বিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন অব সিকিউরিরিজ কমিশন (আইওএসসিও) প্রথমবারের মতো সারা বিশ্বে ২ অক্টোবর থেকে ৮ অক্টোবর ২০১৭ ‘বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ-২০১৭’ পালন করছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আইওএসসিও’র ‘এ’ ক্যাটাগরি সদস্য হিসেবে সপ্তাহটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যাপন করছে। ১৯৮৩ সালে বিশ্বের প্রায় ১০০টিরও বেশি দেশের ২০৭ সিকিউরিটিজ কমিশনকে সদস্য হিসেবে নিয়ে আইওএসসিও গঠিত হয়েছিল।
আইওএসসিও’র অনুরোধে বাংলাদেশে সপ্তাহব্যাপী এ কার্যক্রম পরিচালনা করবে বিএসইসি। এসব আয়োজনের প্রতিপাদ্য হলো‘বিনিয়োগ শিক্ষা ও বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা’। অনুষ্ঠানটি বাস্তবায়নে একটি কমিটি করা হয়েছে। দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমের শুভেচ্ছা দূতের দায়িত্ব পালন করবেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। সম্প্রতি বিএসইসি’র সঙ্গে একটি চুক্তি সই হয়েছে। রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বিএসইসি বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রমের যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তাতে সংস্থাটি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের বিভিন্ন কৌশল ও বিকল্প বিনিয়োগের উপায়, বিভিন্ন সিকিউরিটিজের বৈশিষ্টগুলো সহজভাবে উপস্থাপন, বিনিয়োগের বিভিন্ন ঝুঁকি ও সচেতনতার উপায় এবং দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা ও তা সহজভাবে উপস্থাপন করছে।
বিনিয়োগ শিক্ষাই একজন বিনিয়োগকারীকে সঠিক ও যথাযথ বিনিয়োগ নিশ্চিত করে। এ-ছাড়া বিনিয়োগ শিক্ষা বিনিয়োগকারীকে বিভিন্ন গুজব, প্রভাব, প্রলোভন প্রভৃতি পরিত্যাগ করতে সাহায্য করে। সর্বোপরি বলা যায়Ñবিনিয়োগ শিক্ষা বিনিয়োগকারীকে বিনিয়োগ ও ঝুঁকি সম্পর্কে যথার্থ ধারণা প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগের যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণে উৎসাহ দিয়ে থাকে। আইওএসসিও কিংবা বিএসইসি’র সব আয়োজনের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষা ও পুঁজিবাজারের সামগ্রিক উন্নয়ন।
বিশ্ব বিনিয়োগকারী সপ্তাহ উপলক্ষে পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগ শিক্ষা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা উপস্থাপন করা হলো : ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা থাকলেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত; অন্যথায় নয়। কারণ পুঁজিবাজারে যেমন মুনাফা করা সম্ভব, তেমনি লোকসানের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে জেনে-বুঝে ও পর্যবেক্ষণ করে বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
আশা করা হচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে ও ২০৪১ সালের মধ্যে চলে যাবে উন্নত দেশের কাতারে। এ টার্গেট পূরণে পুঁজিবাজার একটি অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্তমানে পুঁজিবাজারের অবদান জিডিপির মাত্র ২০ শতাংশ। যদিও এশিয়ার অনেক দেশে এ অবদান ১০০ শতাংশেরও বেশি। উন্নত বিশ্বের মতো পুঁজিবাজারকে অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে ব্যবহার করতে হলে আগে বিনিয়োগকারীদের সঠিকভাবে তৈরি করতে হবে। এ লক্ষ্যেই দেশব্যাপী বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে বিএসইসি। বিনিয়োগকারীরা প্রশিক্ষিত হলে তাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগ্রহণে উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের পুঁজিবাজারও অর্থনীতিতে আরও ব্যাপক অবদান রাখতে পারবে।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আগে আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় নিতে হবে। এরপর নিজেকে তৈরি করতে হবে। তারপর আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যা থাকবে, তার একটি অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন। পুঁজিবাজার সম্ভাবনাময় হলেও পরিকল্পিত বিনিয়োগ না করলে সেখান থেকে ভালো ফল পাওয়া যাবে না। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আগে আপনাকে অবশ্যই কিছু বিষয়ের ওপর লক্ষ রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতামত ও দেশ-বিদেশের বাজারের অভিজ্ঞতার আলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহীদের জন্য কিছু মৌলিক বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সব সময় যে এসব বিষয় কার্যকর ফল দেবে এমন নাও হতে পারে। বিশেষ করে স্বল্প মেয়াদে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া মুশকিল।
নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে বিনিয়োগ করলে দীর্ঘ মেয়াদে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে :
এক. পুঁজি বিনিয়োগের আগে অবশ্যই সম্ভাব্য সব বিশ্লেষণ করুন। যে কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করতে চান, সে শেয়ারের বাজার পরিস্থিতিও বিবেচনায় আনুন; তারপর বিনিয়োগ করুন। কেননা পুঁজিবাজার বিশ্লেষণধর্মী বিনিয়োগক্ষেত্র। এখানে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগের কোনো সুযোগ নেই।
দুই. যে কোম্পানিতে বিনিয়োগে আগ্রহী, সে কোম্পানি সম্পর্কে সম্ভাব্য সব খোঁজ-খবর রাখুন। কোম্পানির ব্যবসায়িক অবস্থা, লাভ-ক্ষতির সার্বক্ষণিক খবর রাখুন। কেননা আপনি ওই কোম্পানিটির একটি অংশের মালিকানা কিনতে যাচ্ছেন। সম্ভব হলে নিয়মিত পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট পত্রিকা পড়–ন এবং আপনার সম্ভাব্য বিনিয়োগ যে কোম্পানির শেয়ারে করতে যাচ্ছেন, সে কোম্পানি সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিচার-বিশ্লেষণ করুন ও নোট রাখুন। আমাদের ভুললে চলবে না যে, এটা অবশ্যই একটা ঝুঁকিপূর্ণ বাজার। আপনি এখানে লাভ করতে এসেছেন, আবার ভুল বিনিয়োগে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
তিন. যে কোনো শেয়ারের মূল্য পতন শুরু করলে সাময়িকভাবে অল্প লোকসানে শেয়ার ছেড়ে দেওয়াটা অনেক ক্ষেত্রে যুক্তিসম্মত ও বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে। কোনো গুজব বা সংবাদে ভীত না হয়ে অনেক ক্ষেত্রে কৌশল হিসেবে কিছু লোকসান নেওয়া যেতে পারে। ওই টাকা অন্য শেয়ারে সঠিকভাবে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে।
চার. পুঁজিবাজারে যখন মূল্য সংশোধন হয়, ওই সময় কেনার মতো কিছু অর্থ হাতে রেখে বিনিয়োগ করুন। এখানে একটি ব্যক্তিগত পরামর্শ হলোÑবিনিয়োগযোগ্য টাকার একটি অংশ সব সময় হাতে রাখা উচিত।
পাঁচ. কোনো শেয়ারের দাম যখন বাড়তে থাকে, তখন ধীরে ধীরে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে থাকুন। আর দাম যখন কমতে শুরু করে, তখন আস্তে আস্তে দেখে-শুনে পুনরায় বিনিয়োগ শুরু করুন।
ছয়. কোনো শেয়ারের মূল্য পতন হলে, বিনিয়োগযোগ্য অর্থ হাতে থাকলে পুনরায় ওই একই শেয়ারে বিনিয়োগ করে ওই শেয়ারমূল্যের গড় কমতে পারেন।
সাত. সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে প্রয়োজনে আপনার বিনিয়োগ কৌশল পরিবর্তন করুন। সব শেয়ারের ক্ষেত্রে একই কৌশল কাজে নাও লাগতে পারে।
আট. কোনো কোম্পানির শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে ওই কোম্পানির প্রকাশিত সম্ভাব্য সব তথ্য-উপাত্ত জেনে নেওয়ার পর বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।
নয়. সম্ভাব্য সব বিচার-বিবেচনার পরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভুল হতেই পারে। কম ক্ষতিতে দ্রুত ভুল শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করুন।
দশ. কোনো শেয়ারের মূল্য অস্বাভাবিক বাড়তে থাকলে বা অস্বাভাবিক কমতে থাকলে কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করুন। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চেষ্টা করলে এ অস্বাভাবিকতার মধ্যেও যথেষ্ট আয় করতে পারবেন।
এগারো. বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী সমস্যা বা অস্বাভাবিকতায় ভেঙে পড়েন। এটা মানুষের স্বাভাবিক মানসিকতা। এর বিপরীতে অর্থাৎ এটাকে কাজে লাগিয়ে আয় করার চেষ্টা করুন। ওয়ারেন বাফেটের এ উক্তিটি যথার্থ যে‘সবাইকে যখন খুব সাহসী মনে হবে, তখন আপনাকে একটু বেশি হিসাবি হতে হবে’। আবার সবাই যখন বিনিয়োগে বেশি ভীত হবে, অর্থাৎ পুঁজিবাজার অস্বাভাবিকভাবে পড়তে থাকবে, তখন আপনি সাহসী ভ‚মিকা নিয়ে আস্তে আস্তে বিনিয়োগ করতে পারেন।
বারো. শেয়ারের মূল্য আয় অনুপাত (পিই) দেখুন। পিই রেশিও যত কম হয়, বিনিয়োগে ঝুঁকি তত কম। মূল্য-আয় অনুপাত হচ্ছে একটি কোম্পানির শেয়ার তার আয়ের কতগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে তার একটি পরিমাপ। অন্যান্য বিষয় একই হলে যতটা সম্ভব কম পিই’র শেয়ারগুলোয় বিনিয়োগ অধিক গ্রহণযোগ্য।
তেরো. শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভি) দেখুন। এর সঙ্গে বাজারমূল্যের একটা সামঞ্জস্য থাকা উচিত। যদিও কোম্পানির অবসায়ন (বিলুপ্তি) না হলে সম্পদমূল্যে বিনিয়োগকারীর কার্যত কিছু যায়-আসে না। কোম্পানির অবসায়ন হলেই কেবল শেয়ারহোল্ডাররা ওই সম্পদের কিছুটা ভাগ পেতে পারেন। এক্ষেত্রেও সম্পদ বিক্রির মূল্য থেকে আগে ব্যাংকঋণ ও অন্যান্য পাওনা পরিশোধ করা হয়। এরপর কিছু অবশিষ্ট থাকলে তা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।
চৌদ্দ. শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) দেখুন। এটা যত বেশি হবে, ততই ভালো। ইপিএস বেশি হলে বেশি লভ্যাংশ দেওয়ার সুযোগ থাকে। কম হলে লভ্যাংশের সক্ষমতাও কম হয়।
পনেরো. পুঁজিবাজারের অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করা উচিত নয়। আজকের জন্য যেটি সঠিক সিদ্ধান্ত, কালকের জন্য তা নাও হতে পারে। ত্বরিত কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত নিন।
ষোলো. শক্ত মৌলভিত্তিসম্পন্ন শেয়ার কিনুন, যেটি অপেক্ষাকৃত অবমূল্যায়িত অবস্থায় আছে।
সতেরো. মার্কেট যখন খুব চাঙা হয়ে উঠবে, তখন হাতে থাকা শেয়ার ধীরে ধীরে ছেড়ে দিয়ে মার্কেট পতনের জন্য অপেক্ষায় থাকুন। মনে রাখবেন, চাঙা সময়ে দরপতনের বিষয়টি বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীই চিন্তা করেন না। এটা মানুষের স্বাভাবিক মানসিকতা। এসব ক্ষেত্রে যথাযথ সাবধানতা আপনাকে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে।
আঠারো. অনুমোদিত মূলধন আর পরিশোধিত মূলধনের রেশিও দেখুন। এ দুই মূলধনের পরিমাণ কাছাকাছি থাকলে বোনাস ও রাইট শেয়ার ইস্যু করা বেশ কঠিন। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিকে আগে অনুমোদিত মূলধন বাড়াতে হবে। বোনাস লভ্যাংশে যেসব বিনিয়োগকারীর বিশেষ ঝোঁক রয়েছে, তাদের উচিত এসব বিষয় দেখা নেওয়া।
উনিশ. শেয়ারের বাজারমূল্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিহিত মূল্যের চেয়ে বেশি হতে পারে। তাই লভ্যাংশের হার প্রকৃত রিটার্ন নির্দেশ করে না। ডিভিডেন্ড ইল্ডই শেয়ারের সঠিক রিটার্ন। বাজারমূল্যের ভিত্তিতে প্রাপ্য লভ্যাংশ বিনিয়োগের কত শতাংশ, তা-ই হচ্ছে ডিভিডেন্ড ইল্ড। ঘোষিত লভ্যাংশকে ১০০ দিয়ে গুণ করে সংশ্লিষ্ট শেয়ারের বাজারমূল্য দিয়ে ভাগ করলে ডিভিডেন্ড ইল্ড পাওয়া যায়। এ ইল্ড যত বেশি হবে, বিনিয়োগকারীর প্রাপ্তিও তত বাড়বে। (চলবে)
সিএফও অ্যান্ড কোম্পানি সেক্রেটারি, সুপার স্টার গ্রুপ