অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে টাকার অবমূল্যায়নের প্রস্তাব দিয়েছেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) নেতারা। এ ব্যাপারে তাদের যুক্তি, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমানো হলে বেড়ে যাবে রফতানি আয়। এ যুক্তি যথার্থ, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। রফতানি আয় বাড়াতে উদীয়মান অর্থনীতির অনেক দেশকেই এ কৌশল অবলম্বন করতে আমরা দেখেছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একটিমাত্র যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতেই কি টাকার মূল্যমান কমানো ঠিক হবে?
এর প্রভাব যে শুধু অর্থনীতিতে পড়বে, তা নয়। মুদ্রার অপর পিঠও ভুলে গেলে চলবে না। দেশ অনেক ক্ষেত্রেই এখনও আমদানিনির্ভর। টাকার মূল্যমান কমানো হলে আমদানি করা কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যের দামও যে বাড়বে, সেটি অস্বীকার করা যাবে? মুদ্রার মূল্যমান কমানো হলে তার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। শুধু আমদানি নয়, দেশে উৎপাদন করা পণ্যের দামেও যে এর প্রভাব পড়বে, তা বলা যায়। মূল্যস্ফীতির প্রভাব জনজীবনে কতটা পড়ে, তা কারও অজানা নয়। প্রশ্ন হলো, টাকার মান কমানো হলে পণ্যের দামে এর যে প্রভাব পড়বে, তা সমন্বয় করা হবে কীভাবে? হ্রাসকৃত মানের সঙ্গে সংগতি রেখে মানুষের আয় তো রাতারাতি বাড়বে না।
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন খাতে বেতন বৃদ্ধির যে প্রভাব বাজারে পড়েছে, তা আমাদের পর্যবেক্ষণে আছে। আমরা দেখছি, আয় সমন্বয় না হওয়ায় অনেকে এ চাপ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকরাও এর ভুক্তভোগী। রফতানি আয় বাড়ানোর যুক্তি দেখিয়ে টাকার মূল্যমান কমানো হলে সাধারণের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে। বাজারের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরেই বেতন বৃদ্ধির দাবি নিয়ে সম্প্রতি তারা নেমেছিলেন আন্দোলনে। এ প্রশ্ন অনেকেই তুলবেন, টাকার মূল্যমান কমানোয় রফতানি আয় বাড়লে এর সুফল কি পোশাকশ্রমিকরা পাবেন? এ ব্যাপারে যখন দাবি তোলা হয়েছিল, তখন বিজিএমইএ নেতারা আইন অনুযায়ী পাঁচ বছর পর মজুরি বোর্ড গঠনের যুক্তিই তুলে ধরেছিলেন। টাকার মান কমানো হলে শ্রমিকদের দাবি যে আরও জোরালো হবে, সেটা কি তাদের বিবেচনায় আছে?
আমাদের রফতানি এখনও পোশাক শিল্পনির্ভর। সম্ভবত সেজন্যই দাবিটি উঠেছে এ শিল্পের নেতাদের পক্ষ থেকে। রফতানি আয় বাড়লে শুধু তারা ব্যক্তিগতভাবে নন, অর্থনীতিও চাঙা হবে। টাকার মান কমানোয় যত মানুষ উপকৃত হবেনÑক্ষতিগ্রস্ত হবেন এর চেয়ে বেশি। চাহিদা অনুযায়ী মানুষের ক্রয়-সক্ষমতা কমে গেলে বেড়ে যেতে পারে দুর্নীতি। এর প্রভাব পড়বে জনশক্তি রফতানিতেও। তাতে আবার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত প্রবাসী আয়। আমরা তাই বলবো, টাকার অবমূল্যায়ন এখনই নয়। বর্তমান বাজার অনুযায়ী এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার বাস্তবতা নেই বললেই চলে। মূল্যস্ফীতি কিছুটা স্থিতিশীল থাকার পরও নিত্যপণ্য কিনতে মানুষ যেভাবে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে মুদ্রার অবমূল্যায়ন হবে আগুনে ঘি ঢালার মতো। বাজারের নিয়মেই সৃষ্ট চাপ মোকাবিলা করতে দিশেহারা মানুষ কি এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত সহজভাবে নেবে? এ কারণে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, তাও বিবেচনায় রাখতে হবে নীতিনির্ধারকদের। আমরা বলতে চাই, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সিংহভাগ মানুষের স্বার্থ বিবেচনায় রাখতে হবে। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য টাকার মূল্যমান এখনই কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।