টাকা ছাপিয়ে সরকারকে আর ঋণ দেয়া হবে না

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত অর্থবছর ডিভলভমেন্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে রেকর্ড পরিমাণ ঋণ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই নানা মহলের সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। বিশেষ করে অর্থনীতিবিদরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ধরনের পদক্ষেপের ব্যাপক সমালোচনা করেন। তবে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ ও পরামর্শকে অবজ্ঞা করেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ সরবরাহ অব্যাহত রাখে।

এর নেতিবাচক প্রভাবও পড়েছে অর্থনীতিতে। গত অর্থবছরের মাঝামাঝি থেকেই হু হু করে বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। চলতি অর্থবছরের শুরুতেও তা অব্যাহত থাকে। এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে নিতে শুরু করল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে চলতি অর্থবছর নোট ছাপিয়ে সরকারকে আর অর্থ সরবরাহ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গতকাল সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করে তার পরামর্শ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবদ হাবিবুর রহবান। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ বিষয়ে অবহিত করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক।

বৈঠকে নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ না দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ডিভলভমেন্ট ব্যবস্থায় নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারের ঋণ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে তাকে জানানো হয়। বৈঠক শেষে মেজবাউল হক জানান, ‘দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি। তাই আমরা অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রথম ধাপে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে বসা হয়েছে। ওনাকে মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণ ও এক্সচেঞ্জ রেটের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ সম্পর্কে জানানো হয়েছে। ওনি পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে জোর দিতে বলেছেন।’

মুখপাত্র আরও বলেন, ‘ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বিশেষ করে দুটো বিষয়ে নজর দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে পরামর্শ দিয়েছেন। তা হলোÑ হাই পাওয়ার্ড মানি সৃষ্টি করে (টাকা ছাপিয়ে) সরকারকে ঋণ না দেয়া। এ প্রক্রিয়াটা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ধ করেছে। সরকারকে সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ দিলে হাই পাওয়ার্ড মানি সৃষ্টি হয়, তা সরকারকে জানানো হয়েছে। অন্যটি মূল্যস্ফীতি ম্যানেজমেন্টে পরিবর্তন আনার জন্য বলা হয়। সে বিষয়টি প্রয়োজন হলে আগামী মানিটরি পলিসিতে (মুদ্রানীতি) আনা হবে।’

সরকারকে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়ার ফলে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে বলেও স্বীকার করেন মুখপাত্র। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এক্সচেঞ্জ রেটের একটা বড় ডিভ্যালুয়েশন হয়েছে। সেটার ইম্প্যাক্ট প্রাইস লেভেলে এসে পড়েছে। যেহেতু আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। আরেকটা হলোÑসরকারের গত অর্থবছর ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকমুখী ছিল। অনেকটাই নতুন টাকা সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিতে কিছুটা হিট করেছে। এটা বন্ধ করেছি। হাই পাওয়ার্ড মানি ক্রিয়েট করলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। লাস্ট কোনো ট্রেন্ডারে ডিভলভমেন্ট করে সরকারকে ঋণ দেয়া হয়নি। এ প্রক্রিয়াটা সরকারকেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকার ব্যাংকিং সিস্টেম থেকেই ঋণ নিতে হবে। ব্যাংক খাত যতটুকু পারে ততটুকুই দেবে।’

প্রসঙ্গত, গত অর্থবছর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রকাশনায়ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের ঋণ কমিয়ে সঞ্চয়পত্রসহ অন্য উৎস বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।

সূত্রমতে, সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় তিনভাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার নেয়া মানেই টাকা ছাপানো বা রিজার্ভ মানি বৃদ্ধি। টাকা ধারের তিনটি উপায়ের একটি হচ্ছে ওয়েজ অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্স। অন্য দুটির আনুষ্ঠানিক নাম হচ্ছে ওভার ড্রাফট ও ডিভলভমেন্ট। এর মধ্যে ডিভলভমেন্ট অংশের ঋণের পরিমাণটাই সরকারকে টাকা ছাপিয়ে দিতে হয়।

গত অর্থবছর সরকার ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ২২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছে ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিভলভমেন্ট ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ঋণ দেয়। গত অর্থবছর এ ব্যবস্থায় ৭৮ কোটি ১৪১ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিল। নতুন টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়ার ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মূল্যস্ফীতি গত মাসে ১০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। যদিও সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল তা ৬ শতাংশের নিচে রাখা হবে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এ ব্যর্থতার দায়ভার সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপরেই বর্তায়। কারণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা অন্যতম কাজ বাংলাদেশ ব্যাংকের।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, সার্বিক মূল্যস্ফীতি আগের মতো ৬ শতাংশে নামতে এক বছর সময় লাগবে। আগামী অক্টোবর-নভেম্বর মাসের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করবে। তিনি আরও বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখন বড় আলোচনার বিষয় (বিগ ক্রাই)। সবাই এটি নিয়ে চিন্তিত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানোসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশের অভ্যন্তরীণ কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়েনি। এটি বাইরে থেকে এসেছে।’

এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ১৮ হাজার ৮০৫ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে উল্টো পরিশোধ করা হয়েছে ২২ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে দুই মাসে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের নিট ঋণ কমেছে ৩ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। জুন শেষে সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে মোট ঋণ ছিল ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। আর আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০