নিজস্ব প্রতিবেদক: সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ইতিবাচক থাকলেও পরের তিন মাসে ঋণাত্মক হয়েছে। অর্থাৎ শেষ তিন মাসে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেড়েছে। ফলে গত তিন মাসে নিট বিক্রি (বিনিয়োগ) ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে।
সর্বশেষ নভেম্বরে নিট বিনিয়োগ (বিক্রি) ঋণাত্মক হয়েছে এক হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। আগের মাসেও নিট বিক্রি এক হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণাত্মক ছিল। সেপ্টেম্বরে ঋণাত্মক ছিল ১৪৭ কোটি টাকা। যদিও অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ভাঙানোর প্রবণতা কম থাকায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ বেশ বেড়েছিল। ওই দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) নিট বিক্রি পাঁচ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা ইতিবাচক ছিল।
সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়েছে তিন হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়েও নিট বিক্রি ঋণাত্মক ধারায় ছিল, তবে ওই সময় এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ৬১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ নিট বিক্রি ঋণাত্মক বেড়েছে ১৪০ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। কারণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে প্রতিবছর সরকার যে ঋণ নিচ্ছে, তার বিপরীতে সরকারকে বিপুল পরিমাণে সুদ দিতে হচ্ছে। এ সুদ জনগণের করের টাকা। বাজেটের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সরকারের ব্যয়ের পরিমাণ এক লাখ ৭৩ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা। আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। ঋণের সঙ্গে কিছু শর্তও জুড়ে দিয়েছে সংস্থাটি। আইএমএফ শর্ত দিয়েছে, সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ এখন যা আছে, তা ২০২৬ সালের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ কমিয়ে ফেলতে হবে। সঞ্চয়পত্র বিক্রির সুদ ব্যয় কমিয়ে আনতে সংস্থাটি এ শর্ত দিয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পণ্য ও সেবার দামে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে মানুষের, যার প্রভাব পড়ে সঞ্চয়ের ওপরও। বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ে যাদের সংসার চলে, তাদের অনেকে এখনও সঞ্চয়পত্র ভেঙে খাচ্ছেন। এছাড়া নানা কড়াকড়ির কারণেও এ সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অনেকে। ফলে এ খাতে আশানুরূপ বিক্রি বাড়ছে না।
নিম্ন মধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষ, মহিলা, প্রতিবন্ধী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে সঞ্চয়পত্রে তুলনামূলক বেশি মুনাফা (সুদ) দেয় সরকার। তবে কড়াকড়িসহ বিভিন্ন কারণে গত অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসেই সঞ্চয়পত্রের বিক্রিতে ধস নামে। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে নিট বিক্রি বেশ বেড়েছিল। কারণ এ সময়ে যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল, তার চেয়ে ভাঙানোর পরিমাণ ছিল অনেক কম।
প্রসঙ্গত, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্র থেকে ভাঙানো বাবদ (নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে বা মেয়াদান্তের আগে) আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে তাকে নিট বিক্রি বলা হয়। নিট বিক্রিকে সরকারের ধার বা ঋণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। তবে বিক্রি কমতে থাকায় সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ধরা হয় ৩২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি দাঁড়ায় ঋণাত্মক প্রায় তিন হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ গত অর্থবছরের পুরো সময়ে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রি হয় ৮০ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। একই সময়ে সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর পরিমাণ ছিল ৮৪ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। এর মানে পুরো অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকার এক টাকারও ঋণ পায়নি। মূলত গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে বেশি ভাঙানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে।
২০২১-২২ অর্থবছরেও সঞ্চয়পত্র থেকে তুলনামূলকভাবে কম ঋণ পেয়েছিল সরকার। পুরো অর্থবছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নিট ঋণ আসে ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। অথচ কভিড-১৯ মহামারির পরও ওই অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ হয়েছিল প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকার। এটি তার আগের অর্থবছরে ছিল মাত্র ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।
গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৬৩ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের অক্টোবরে সরকারের অভ্যন্তরীণ উৎসের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ছিল সাত লাখ পাঁচ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের একই মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৯ হাজার ৯১৮ কোটি টাকায়। ব্যাংক থেকে নেয়া সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় তিন লাখ ৮২ হাজার ৬০৯ কোটি টাকায়। এছাড়া ব্যাংক-বহির্ভূত খাত থেকে নেয়া পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় চার লাখ ২৭ হাজার ৩০৯ কোটি টাকায়।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, মূল্যস্ফীতির তুলনায় সুদহার কম। সুদহার কম হওয়ায় মানুষ বিনিয়োগ করতে পারছে না। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে গেছে, কিন্তু সেই অনুযায়ী আয় বাড়ছে না। তাই বিনিয়োগ কমেছে।
তিনি আরও বলেন, সঞ্চয়পত্রে এখন নানা ধরনের নিয়ম করা হয়েছে। কড়াকড়ির কারণেই মূলত সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। যারা মূলত অনিয়ম করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। সবাই তো আর অনিয়ম করে না। অল্প বিনিয়োগ যারা করে তাদের জন্য এ নিয়ম মানা কঠিন। তাই এখানে তারা বিনিয়োগ করতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।