বিশ্বের অধিকাংশ দেশে টার্কি গৃহপালিত পাখি হিসেবে পালন করা হলেও বাংলাদেশে এখনও খুব একটা পরিচিতি পায়নি নিরীহ প্রকৃতির এই পাখিটি। দেখতে মুরগির মতো হলেও বৃহদাকৃতির কারণে সাধারণ মানুষের কাছে টার্কির মাংস এখনও উপভোগ্য হয়ে ওঠেনি। তবে ইদানীং রাজধানীসহ দেশের অনেক স্থানে পাখিজাতীয় এই টার্কির পালন শুরু হয়েছে। সাভারের বেশ কয়েকটি স্থানে বাণিজ্যিকভাবে টার্কি পালন করে লাভবান হচ্ছেন অনেকে। ব্রয়লার, কক ও সোনালি প্রজাতির মুরগি পালনের চেয়ে খরচ তুলনামূলক কম এবং লাভ বেশি হওয়ায় টার্কি পালনে আগ্রহ বাড়ছে এখানকার পোলট্রি ব্যবসায়ীদের মাঝে। অনেকেই আবার শখের বসে বাড়িতে পালন করছেন টার্কি।
সাভারের রাজাসন, থানাস্ট্যান্ড, গেন্ডা, দোসাইদ, কলমা ও আশুলিয়ার নবীনগর, পল্লীবিদ্যুৎ, গাজীরচটসহ প্রায় ৩০টি স্থানে ছোট-বড় পরিসরে টার্কি মুরগি পালন করা হচ্ছে।
আশুলিয়ার টাকশুর এলাকার বাঁধন এগ্রোফার্মের স্বত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম উজ্জ্বল বলেন, আগে পোলট্রি ফিডের একটি প্রতিষ্ঠানের সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে এই এলাকায় কাজ করতেন। পরে পোলট্রি ফিড সরবরাহ করতে গিয়ে দানেশ ঢালি নামে এক ব্যবসায়ীর তার পরিচয় হয়। ওই পোলট্রি ব্যবসায়ী লোকসানের কারণে ব্যবসা ছেড়ে দিলে তিনি একই জায়গা ভাড়া নিয়ে ব্রয়লার ও লেয়ার পালন শুরু করেন। চাকরির সুবাদে এগ্রোটেক ফিডস লিমিটেডের কনসালট্যান্ট ডা. মাকসুদুর রহমান ও গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি বিভাগের প্রভাষক ডা. জামিনুর রহমানের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তারাই তাকে ব্রয়লারের পাশাপাশি টার্কি পালনে উদ্বুদ্ধ করেন। এরপর সোহেল ও বাঁধন নামে আরও দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে যৌথভাবে ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
সাতক্ষীরা থেকে একশ’টি এক মাস বয়সী বাচ্চা কেনেন। টার্কি সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকায় এর কিছু দিন পর রক্তে টকসিনের সংক্রমণে ৫০টি বাচ্চা রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আতঙ্কিত হয়ে কম মূল্যে ২০টি বাচ্চা বিক্রি করে দেন। পরে ডা. মাকসুদুর রহমান ও ডা. জামিনুর রহমান তাকে টার্কি পালন প্রক্রিয়া রপ্ত করান। বর্তমানে স্টোকস, নরফোল ব্রোঞ্চ, রেড বার্বন ও রয়েল পামপ নামে চার প্রজাতির প্রায় আড়াইশ টার্কি তার ফার্মে রয়েছে।
তিনি বলেন, তার ফার্মের প্যারেন্টস স্টোকস প্রজাতির ১৭০টি টার্কির মধ্যে ১২০টি টার্কি এখন ডিম দিচ্ছে। প্রতিটি টার্কি বছরে অন্তত একশ ডিম দেয়। আর ডিমপ্রতি সর্বোচ্চ দেড়শ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে এখন চাহিদা বেশি থাকায় তিনি ভাড়ায় ইনকিউবেটরে ফুটিয়ে বাচ্চা বিক্রি করেন। গাজীপুর, কুমিল্লা, বরিশাল, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তার এখানে টার্কির বাচ্চা কিনতে আসে অনেকেই। বর্তমানে তার ফার্মে প্রতি সপ্তাহে ৬০০ থেকে ৭০০ বাচ্চা উৎপাদন হলেও তিনি গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না। তাই ব্রয়লার ও অন্যান্য মুরগি পালনের চেয়ে টার্কি পালন অনেক বেশি লাভজনক হওয়ায় ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে শুধু টার্কি পালন করবেন বলেও জানান এই পোলট্রি ব্যবসায়ী।
আমিনুল ইসলামের ব্যবসায়িক অংশীদার মো. সোহেল জানান, টার্কি পালনে অন্য মুরগি যেমন ব্রয়লার, কক ও সোনালি প্রজাতির চেয়ে খরচ তুলনামূলক কম। একটি টার্কি দিনে মাত্র পাঁচ টাকার ১২০ গ্রাম খাবার (পোলট্রি ফিড) খেয়ে থাকে। পাশাপাশি কলমিশাক, ঘাস, কচুরিপানা ও বাঁধাকপিও এদের পছন্দের খাবার। এছাড়া টার্কি মুরগির মাংস খুবই সুস্বাদু ও কোলেস্টেরল মুক্ত হওয়ায় দিন দিন এর চাহিদা বাড়ছে। আগে তার খামারে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা কেজি দরে প্রায় ১০০ থেকে ২০০ কেজি মাংস বিক্রি হতো। এখন তা বেড়ে প্রায় দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার কেজি হয়েছে। যেহেতু এর মাংস খাদ্য হিসেবে সেভাবে পরিচিতি পায়নি, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ব্যাংক কর্মকর্তারা নিয়মিত ক্রেতা। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে তার আড়াইশ টার্কির জন্য খরচ মাত্র দেড় লাখ টাকা। লাভ কয়েক গুণ বেশি।
বাঁধন এগ্রোফার্ম থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করে টার্কি পালনে সফলতা পেয়েছেন মানিকগঞ্জের কাজী মোজাফফর হোসেন, আশুলিয়ার আনোয়ার হোসেন, রুবায়েত ও ধামরাইয়ের দেলোয়ার হোসেনসহ অনেকেই। তারা বলেন, ইন্টারনেট ও টেলিভিশনের মাধ্যমে তারা টার্কি পালনে উদ্বুদ্ধ হন। টার্কি পালন অত্যন্ত সহজ ও লাভজনক। যদিও রানীক্ষেত, গামব্রু ও ফাউলপক্স নামের রোগে আক্রান্ত হয় টার্কি। তবে ছয়, সাত, পনের ও ত্রিশ দিন বয়সে চারটি ভ্যাকসিন দিলে এই রোগের সংক্রমণ রোধ করা যায়। তাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে টার্কি পালন করে বেকারত্ব অনেকটা দূর করা সম্ভব হবে। তেমনি টার্কির মাংস দেশের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করে রফতানি করা যাবে বলে দারুণ আশাবাদী এই টার্কি ব্যবসায়ীরা।
সাভার উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা
ডা. ফজলে রাব্বী মণ্ডল বলেন, ব্রয়লার, হাঁস, মুরগি, কোয়েলসহ পোলট্রির ১১টি প্রজাতির মধ্যে টার্কিও একটি। টার্কির মাংস যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিকর। এছাড়া গরুর মাংসে চর্বির পরিমাণ ২.৬ শতাংশ, মহিষে ০.৯ শতাংশ, খাসিতে ৩.৬ শতাংশ ও ভেড়ায় ৪.৪ শতাংশ থাকলেও টার্কিতে চর্বি রয়েছে শূন্য শতাংশ। গরুর মাংসে প্রোটিন রয়েছে ২২.৬ শতাংশ, মহিষে ১৯.৪ শতাংশ, খাসিতে ২১.৪ শতাংশ ও ভেড়ার মাংসে ১৮.৫ শতাংশ। অপরদিকে টার্কির মাংসে প্রোটিন রয়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। তাই ডায়াবেটিস ও হৃদযন্ত্রের সমস্যাজনিত রোগে যারা ভোগেন, তারা অনায়াসে টার্কির মাংস খেতে পারেন। তিনি আরও বলেন, পৃষ্ঠপোষকতা বলতে আমরা সরকারিভাবে প্রাণিসম্পদ অফিসের মাধ্যমে এ ধরনের পোলট্রি ব্যবসায়ীদের পশুপাখি পালন ও রোগে আক্রান্ত হলে সেবা দিয়ে থাকি।
ইমতিয়াজ উল ইসলাম