নিজস্ব প্রতিবেদক : দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রটোকলের শর্ত অনুসারে কমপ্লায়েন্ট হতে হবে। অথচ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু-পরবর্তী ত্রাণ কার্যক্রমে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়েছে। ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে আত্মীয় ও অনুসারীদের প্রাধান্য দেওয়া, ত্রাণের চাল বিতরণের সময় মাপে কম দেওয়াসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা বঞ্চিত হয়েছেন।
গতকাল বুধবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
ধানমণ্ডির কার্যালয়ে ‘ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু: দুর্যোগ মোকাবেলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। সংস্থাটির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার এম. জাকির হোসেন খানের নেতৃত্বে এ গবেষণা করেছেন নিহার রঞ্জন রায়, নেওয়াজুল মওলা ও নাহিদ শারমীন।
টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের ও রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
গবেষণায় বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে জরুরি ত্রাণ সহায়তা হিসাবে ৫ হাজার ৬৮২ টন চাল ও এক কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জরুরি উদ্ধারকাজ চালানোর জন্য ১২টি পিকআপ ভ্যান, ১২টি উদ্ধার নৌকা, ছয়টি মোবাইল অ্যাম্বুলেন্স এবং চারটি উত্তাল সমুদ্রে অনুসন্ধান উপযোগী উদ্ধার নৌকার বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু দুর্যোগ-পরবর্তী ওইসব ত্রাণ কার্যক্রমে সুশাসনের নির্দেশকগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, জনঅংশগ্রহণ ও শুদ্ধাচারের একটি সূচকেও পূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত ১৫টি জেলার মধ্যে পাঁচটি জেলায় এ জরিপ চালানো হয়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, ভোলা ও বরগুনায় জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, রোয়ানুতে চট্টগ্রাম এলাকায় সবচেয়ে বেশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ত্রাণ বরাদ্দের ক্ষেত্রে ভোলা ও বরগুনা জেলা অধিকতর প্রাধান্য পেয়েছে। চট্টগ্রামে ১৯ হাজার ঘরবাড়ি আংশিক ও প্রায় ২০ হাজার ঘড়বাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে ভোলা জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘড়-বাড়ির সংখ্যা মোট চার হাজার। কিন্তু ত্রাণ বরাদ্দের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম এলাকায় পরিবারপ্রতি ৪০১ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও ভোলায় পরিবারপ্রতি বরাদ্দ পেয়েছে দুই হাজার ৩৩৫ টাকা। প্রভাবশালী মহলের চাপে কর্মকর্তারা এমনটা করেছেন বলে গবেষকরা জানিয়েছেন। এছাড়া বেশ কিছু ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নিকটআত্মীয় ও অনুসারীরা অগ্রাধিকার পেয়েছেন। ত্রাণের চাল বিতরণে মাপে কম দেওয়া, সরকারিভাবে ঢেউটিন বিতরণ দেখানো হলেও ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে না পৌঁছানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের অর্জন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হয়েছে। টিআইবি আশা করে এই প্রতিবেদনে উপস্থাপিত তথ্য, বিশ্লেষণ ও সুপারিশ বাংলাদেশে দুর্যোগ মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপে অধিকতর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, নাগরিক অংশগ্রহণ এবং শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।’
গবেষণায় বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন, এনজিওবিষয়ক ব্যুরো ও তথ্য অধিদফতরের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ২১ মে উপকূলীয় এলাকায় রোয়ানু আঘাত হানে। এতে ২৭ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ প্রসঙ্গে গবেষক দলের প্রধান এম জাকির হোসেন খান বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে সান্ডাই ফ্রেমওয়ার্ক, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ও প্যারিস অ্যাগ্রিমেন্টের শর্তগুলো পূরণ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা অর্জন করতে হবে বাংলাদেশকে। এসবের অন্যতম উপাদান হলো সুশাসন। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুকে আমরা একটা কেস স্টাডি হিসেবে নিয়েছি। এর মাধ্যমে আমরা ধারণা পেয়েছি, সক্ষমতা অর্জনে কতটা পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।’