টিকাদানে বাংলাদেশের সাফল্য

মো. নূরুল আবছার: শিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই পরিবারের সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আত্মীয়স্বজন সবাই নতুন শিশুকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়। শিশু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রোগ জীবাণুর আক্রমণের শঙ্কায় মা-বাবার চিন্তা বাড়ে। সব মা-বাবাই চান তার শিশু যেন সুস্থ থাকে। আর শিশুর সুস্থতার জন্য শিশুর টিকা দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টিকার মূল উদ্দেশ্য শিশুকে রোগ থেকে দূরে রাখা।

গত ৫ জুন শনিবার থেকে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন ২০২১। শুক্রবার ছাড়া এ ক্যাম্পেইন চালু থাকবে ১৯ জুন পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত এ টিকা খাওয়ানো হচ্ছে। সারাদেশের মোট ২ কোটি ২০ লাখ ৫৪ হাজার শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। এই সময় ৬ থেকে ১১ মাস বয়সী ২৫ লাখ ৪৭ হাজার শিশুকে একটি করে নীল রঙের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল এবং ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী ১ কোটি ৯৫ লাখ ৭ হাজার শিশুকে একটি করে লাল রঙের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল বিনামূল্যে খাওয়ানো হবে। একই সঙ্গে আন্তঃব্যক্তি যোগাযোগ ও গণমাধ্যমের সহায়তায় জন্মর পরপরই (১ ঘণ্টার মধ্যে) শিশুকে শালদুধ খাওয়ানোসহ প্রথম ৬ মাস শিশুকে শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো এবং শিশুর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলে মায়ের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি পরিমাণ মতো সুষম খাবার খাওয়ানো বিষয়ে প্রচারাভিযান চালানো হচ্ছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিকসহ সবার সার্বিক সহযোগিতায় দেশব্যাপী ১ লাখ ২০ হাজার স্থায়ী কেন্দ্রসহ অতিরিক্ত আরও ২০ হাজার ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্রগুলো বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট, ব্রিজের টোল প্লাজা, বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, খেয়াঘাট ইত্যাদি স্থানে অবস্থান করবে। প্রতিটি কেন্দ্রে কমপক্ষে ২ জন প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবী দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া দুর্গম এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ১২টি জেলার ৪৬টি উপজেলার ২৪০টি ইউনিয়নে ক্যাম্পেইন-পরবর্তী ৪ দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের সার্চিং কার্যক্রম পরিচালনা করে বাদ পড়া শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। এ কার্যক্রম সফল করতে ইতোমধ্যে বিভাগ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা-উপজেলায় অবহিতকরণ সভা এবং সিটি করপোরেশন, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ২ লাখ ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

শিশুর সুস্থভাবে বেঁচে থাকা, স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও দৃষ্টি শক্তির জন্য ভিটামিন ‘এ’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন ‘এ’ চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টি শক্তি ও শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বজায় রাখে এবং বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে রাতকানা এবং অন্ধত্বসহ চোখের অন্যান্য রোগসহ শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া, রক্তশূন্যতা এবং শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সরকারের স্বাস্থ্য নীতিমালা অনুযায়ী বছরে ২ বার ভিটামিন ‘এ’-এর অভাব পূরণের সম্পূরক খাদ্য হিসেবে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়ে থাকে। এ ক্যাম্পেইনটি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। গণমাধ্যম এবং মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাপসুল খাওয়ানোর বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভ্যাকসিন হিরোর দেশ বাংলাদেশ। ‘আপনার শিশুকে টিকা দিন’ সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির এই বার্তা সারাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। সন্তান জন্ম নেয়ার আগেই মা-বাবা জেনে নেন শিশুর টিকার প্রয়োজনীয়তা কী? জন্মের পরপরই শিশু পায় টিকা, পায় সুরক্ষা। বয়স দুই বছর পূর্ণ হওয়ার আগে দেশের ৮২ শতাংশের বেশি শিশু জীবনরক্ষাকারী টিকা পায়। অনেক ক্ষেত্রে এই হার ৯৯ শাতংশ। টিকাদানে বাংলাদেশের এই সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বা ইপিআই’র পাশাপাশি সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ে কর্মসূচি ব্যবস্থাপনার কারণে টিকাদানে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করেছে।

আগে দেশে শিশুর মৃত্যুহার অনেক বেশি ছিল। শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধি। এসব ব্যাধি থেকে শিশুকে রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে দেশে শুরু হয় সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি। শুরুতে শিশুদের ছয়টি রোগের টিকা দেয়া হতো। যক্ষ্মা, ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, পোলিও ও হাম। শুরুর দিকে টিকা দেয়া হতো হাসপাতালে। টিকা পেত মূলত শহরের শিশুরা। ১৯৮৫ সাল নাগাদ ২ থেকে ৩ শতাংশ শিশু টিকার আওতায় আসে। ওই বছর থেকেই ইউনিভার্সাল চাইল্ডহুড ইমিউনাইজেশন কর্মসূচির মাধ্যমে শহর ও গ্রামের শিশুকে টিকা দেয়া শুরু হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘স্বাস্থ্য বুলেটিন ২০১৯’ বিভিন্ন সময়ে হাতে নেয়া কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ১৯৯০ সালে ইপিআই সেবা সব জনগোষ্ঠীর কাছে নেয়া শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে পোলিও নির্মূল এবং মা ও নবজাতকের ধনুষ্টংকার নির্মূল কর্মসূচি শুরু হয়। ২০০৩ সালে শুরু হয় হেপাটাইটিস বি টিকা দেয়া এবং ২০১২ সালে এমআর টিকা এবং হামের দ্বিতীয় ডোজ দেয়া শুরু হয়। ২০১৫ সালের মার্চে নতুন করে পিসিভি ও আইপিভি টিকা দেয়া শুরু হয়। নিউমোনিয়ার টিকা (পিসিভি), হাম ও রুবেলার টিকা (এমআর)। সরকারি কর্মসূচিতে যক্ষ্মার (বিসিজি) ও মুখে খাওয়ার পোলিও টিকা (ওপিভি) জšে§র পরই দেয়া যায়। যক্ষ্মার টিকায়  হাতে দাগ তৈরি না হলে ১৪ সপ্তাহে আবার তা দিতে হবে। দেশে বর্তমানে ১০ ধরনের টিকা দেয়া হয়। ০ থেকে ১০ বছর বয়সী সব শিশু এবং ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তান ধারণক্ষম নারী টিকা কর্মসূচির আওতায় আছে।

শিশুর শূন্য থেকে ১৫ মাস পর্যন্ত মোট পাঁচবার টিকাকেন্দ্রে যেতে হয়। প্রথম তিনটি টিকা দিতে হয় দেড় মাস, আড়াই মাস ও তিন মাস ১৫ দিনে। যক্ষ্মার টিকা ছাড়া এই টিকাগুলো মোটামুটি একই ধরনের। শেষ দুটি হলো এমআর (হাম ও রুবেলা) টিকা। এটি দিতে হয় শিশুর বয়স ৯ মাস শেষ হলে এবং ১৫ মাসে। একই ধরনের দুটি টিকার মধ্যে ন্যূনতম এক মাস সময়ের ব্যবধান থাকতে হয়। এ কারণে শিশুর টিকার কার্ডে পরবর্তী যে তারিখে টিকা দেয়ার কথা লেখা আছে, তার আগে দেয়া যাবে না। কিন্তু পরে দিতে বাধা নেই। তবে শিশুর ২ বছর বয়সের মধ্যে সবগুলো টিকা শেষ করতে হবে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ঘরে থাকছেন বেশিরভাগ মানুষ। এতে মা-বাবা উদ্বিগ্ন রয়েছেন। বিশেষ করে নবজাতক শিশুদের ক্ষেত্রে দুশ্চিন্তা বেশি। তবে করোনার এই দুর্যোগের মধ্যেও আমাদের দেশে টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। অনেক এলাকায় বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকা দিচ্ছেন। জরুরি হলে সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বাড়িতে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়। স্বাস্থ্যকর্মী যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিশুকে টিকা দিতে যান, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

২০০১ সাল থেকে টিকার আওতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ২০০১ সালে ১২ মাস বয়সী ৫২ শতাংশ শিশু টিকার আওতায় আসে। ২০১৯ সালে এই হার ছিল ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশ। একইভাবে ২৪ মাস বয়সী শিশুদের বিভিন্ন ধরনের টিকা পাওয়ার হারও অনেক বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিসিজি টিকা দেয়ার হার শতভাগ। ইপিআই কর্মসূচির ফলে ২০০৮ সাল থেকে মা ও নবজাতকের ধনুষ্টংকার দূরীকরণ সম্ভব হয়েছে। ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে পোলিও নির্মূল সনদ লাভ করে।

টিকাদান কর্মসূচিকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বড় ধরনের সাফল্য হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে বিবেচনা করা হয়। এই সাফল্যের একাধিক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। টিকার ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদর দপ্তরে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনের (গাভি) বোর্ড চেয়ার এনগোজি ওখানজো ওয়েলা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ হিসেবে পুরস্কৃত করেন। আশির দশকে দেশে শিশুর রাতকানার হার ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো অব্যাহত রাখায় বর্তমানে ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবজনিত রাতকানা রোগের হার শতকরা ০ দশমিক ১ ভাগের নিচে নেমে এসেছে। টিকাদানের ফলে প্রতি বছর বহু শিশুর জীবন বাঁচাচ্ছে। টিকাদানের এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবেÑআমাদের বলিষ্ঠ ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রজš§ গড়ার স্বার্থে।

পিআইডি নিবন্ধন

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১