তানভীর এ মিশুক: একসময় গোটা বিশ্বই বুঝে না বুঝে অপরিকল্পিতভাবে অনেক উন্নয়নকাজে ব্যস্ত হয়েছে। যার ফলে হুমকিতে পড়েছে বিশ্বের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ। বলা বাহুল্য, ওই উন্নয়ন পৃথিবীর অগুণিত মানুষকে তাদের ভাগ্যের উন্নয়নের স্থায়ী কোনো সমাধান দিতে পারেনি। বরং অনেক ক্ষেত্রেই ধরণী পড়েছে ঝুঁকির মধ্যে। এর ফলে উন্নয়ন লক্ষ্য খানিকটা বদলে টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে চলতে যাত্রা করেছে গোটা বিশ্ব।
টেকসই এই উন্নয়নের লক্ষ্য ঠিক হয় আজ থেকে ঠিক সাত বছর আগে, ২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য বা সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) চূড়ান্ত করা হয়। আর এক্ষেত্রে সময় নির্ধারিত হয় ২০৩০ সাল পর্যন্ত। নাম দেয়া হয় ‘২০৩০ এজেন্ডা’। আমরা বাংলাদেশে যারা মোবাইল আর্থিক সেবা নিয়ে কাজ করছি তারা বেশ জোরেশোরেই আছি এই ২০৩০ এজেন্ডার মধ্যে। আমাদের লক্ষ্য, এই সময়ের মধ্যেই অনেকগুলো জায়গায় গুণগত পরিবর্তন আনা।
গত সাত বছর আগে, যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় সেখানে সুনির্দিষ্ট করে ১৭টি বিষয় উল্লেখ করে ছিল জাতিসংঘ। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, জাতি হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনেকে জায়গায় কিন্তু গুণগত উন্নতি করেছে। বরাবরের মতোই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই এসডিজির লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য কাজে রয়েছি আমরা। এর আগেও কিন্তু আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য বা এমডিজি অর্জনে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছি। সেই ধারাবাহিকতায় এখন এসডিজি নিয়ে কাজ করছি আমরা।
ইতোমধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, লিঙ্গ সমতা, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির মতো বিষয়ে ইতিবাচক ফল মিলেছে। তবে আমি গর্বের সঙ্গে বলতে চাই, সরকারের সহযোগী হিসেবে নগদও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের পথে নেতৃত্বের অবস্থানে থেকে কাজ করছে।
মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা হলেও আমরা কিন্তু নগদকে শুধু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টাকা লেনদেনের বাহন হিসেবে রাখতে চাইনি। শুরু থেকেই আমরা বরং চেয়েছি সামগ্রিক উন্নয়ণের অংশীদার হতে। সে জন্য এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে অন্তত ৯টিতে পরিষ্কার অবদান রেখে চলেছে নগদ।
ধরুন না, এসডিজির এক নম্বর লক্ষ্যের কথাই। এখানে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের দারিদ্র্যের অবসান করা হবে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, এখানে নগদ কীভাবে ভূমিকা রাখল? উত্তরটা হলো প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকে তাদের আর্থিক উন্নতির হাতিয়ার হিসেবে তৈরি করতে সহায়তা করেছে নগদ। আর এটা করতে গিয়ে দারিদ্র্য অবসানের কাজটাও করা হয়ে গেছে। নগদ থেকে সরকারের বিভিন্ন সহায়তা ও নানা ধরনের ভাতা বিতরণ করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় বিধবা, স্বামী নিগৃহীতা, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী শিশুদের আর্থিক সক্ষমতায় অবদান রেখেছে নগদ। এই প্রক্রিয়ায় আসলে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন লক্ষ্যের পথেই বড় অগ্রগতি হয়েছে।
এই ভাতা বিতরণকে নগদ কেবল সহজ করেনি, এই কাজ করতে গিয়ে সাড়ে ছয় কোটি গ্রাহকের এক পরিবার গড়ে তুলেছে। যার ফলে এসডিজির দ্বিতীয় লক্ষ্য খাদ্য নিরাপত্তাতেও ভূমিকা রাখতে পেরেছে নগদ। যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ এক সময় মঙ্গাসহ নানা দারিদ্র্যে ভুগত, সেখানে নগদের মাধ্যমে সরকারের ভাতা পৌঁছে গেছে সহজে নিঝঞ্ঝাটে। এমনকি কভিডের মতো জরুরি সময়েও মানুষ সহজে ঘরে বসে সরকারি সহায়তা পেয়ে গেছে। ফলে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা অনেকটাই নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।
এসডিজির তৃতীয় ও চতুর্থ লক্ষ্য হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত। সরকারের অন্যান্য ভাতার মতো প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি বিতরণ করার মাধ্যমেও ঝরে পড়ার হার রোধ করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব হচ্ছে। আমি তো বলব এ ক্ষেত্রে নগদের যে অবদান, তা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। আমরা দেশের কয়েক লাখ শিশুর অভিভাকের কাছে শিক্ষা বৃত্তি পৌঁছে দিচ্ছি বিনা খরচে। ফলে শিক্ষা খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য মিলছে। বিভিন্ন সমীক্ষায়ও কিন্তু এই তথ্য বেরিয়ে আসছে।
লৈঙ্গিক বৈষম্য সব সময়েই আমাদের বড় সমস্যা। এখানেও ভূমিকা রাখতে পারছি আমরা। বিধা বা স্বামী নিগৃহীতা ভাতা তো সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করছে। যারা এর আগে সমাজের মূলস্রোতে সেভাবে আসারই সুযোগ পেতেন না, তারাও এখন নগদের ডিজিটাল সেবার হাত ধরে নিজেদের অবস্থার উন্নয়নের কাজ করছেন। নগদের উদ্যোক্তা হিসেবেও কাজ করছেন এমন অনেক নারী যারা এর আগে একবারেই কর্মহীন ছিলেন। এসডিজির পঞ্চম লক্ষ্য এই লৈঙ্গিক সমতা নিশ্চিত করা। নগদ গর্বের সঙ্গে বলতে চায় যে, তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নারীরা।
সবর জন্য কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে এসডিজির আট নম্বর লক্ষ্যে। নগদ প্রতিষ্ঠান হিসেবেই প্রায় আড়াই লাখ উদ্যোক্তাসহ অন্তত তিন লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান করেছে। এ ছাড়া নগদের সঙ্গে কাজ করা এসব উদ্যোক্তার মাধ্যমে আরও কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাছাড়া নগদের লেনদেনের সেবা নিয়ে আরও অসংখ্য মানুষ তাদের কর্মসংস্থানের অবস্থানকে আরও উন্নত করেছেÑএ হিসাব আমাদের কাছে নেই।
এই কাজগুলো করতে গিয়েই সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে বেশ কিছুটা ভূমিকা রাখছে নগদ। আমাদের কর্মকাণ্ড একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিতে নিয়ে এসেছে। ফলে এসডিজির ১০ নম্বর লক্ষ্য অনুযায়ী অসমতা কমানোর জন্য কাজ করে যেতে পারছি আমরা।
নগদ শুরু থেকেই তার প্রধান শক্তি হিসেবে সামনে এনেছে উদ্ভাবন ও বিকল্প ভোগের ব্যাপারকে। নগদ মনে করে ট্র্যাডিশনাল পণ্য ভোগের থেকে সরে এসে ডিজিটাল কেনাকাটার সময় এসেছে। আর এটাই এসডিজির ১২ নম্বর লক্ষ্য। তারাও চায় কাগজের মতো ট্র্যাডিশনাল উপকরণ ব্যবহার কমিয়ে আনতে, যা পরিবেশকে রক্ষা করবে। নগদের মতে, ক্যাশলেস সোসাইটিই পারে এই লক্ষ্য অর্জন করতে। দেশব্যাপী ডিজিটাল সেবাকে উৎসাহিত করার মাধ্যমেও প্রচলিত সেবার উত্তরণ ঘটিয়েছে নগদ। এই যেমন আগে যেখানে আট-দশ পৃষ্ঠার ছাপানো কেওয়াইসির মাধ্যমে গ্রাহক নিবন্ধন হতো, নগদ বাজারে আসার পর থেকে তো আর সেটি করতে হচ্ছে না। শুধু নগদের মাধ্যমেই সাড়ে ছয় কোটি গ্রাহকের নিবন্ধন হয়েছে ইলেকট্রনিক কেওয়াইসির মাধ্যমে। তাছাড়া নগদের উদ্ভাবন কপি করে অন্যান্য সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানই এখন তাদের কাগুজে কেওয়াইসি বাতিল করেছে। ফলে এক্ষেত্রে কাগজের ব্যবহার বন্ধ হয়েছে, যার একই সঙ্গে পরিবেশের ওপর ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
এসডিজির ১৬ নম্বর ধারা বলছে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা। কয়েক বছর আগের কথা চিন্তা করলেও এই দেশের কোটি কোটি মানুষ আর্থিক কর্মকাণ্ডের বাইরে ছিল। এখনও লাখ লাখ মানুষ সব ধরনের ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডের বাইরে আছেন। আর এই মানুষগুলোকেই মূল স্রোতে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় নগদ। এটা আমাদের মূল লক্ষ্যগুলোর একটা।
আমরা মনে করি, এই সময়টা কোনো কিছু অপসময়ের নয়, এই সময়টা কোনোক্রমে উন্নয়ন চালানোর নয়। বরং উন্নয়ন হতে হবে টেকসই। এই মনে করা থেকেই সরকারের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে কাজ করে চলেছি আমরা। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার যে জাতীয় লক্ষ্য আমাদের আছে, এসডিজি হতে পারে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়ার একটা সিঁড়ি। আর এক্ষেত্রে আমাদের হাতিয়ার হবে নগদ। ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হলে লক্ষ্যের দিকে আগের চেয়েও অনেক দ্রুতগতিতে ছুটতে পারব আমরা।
দেশের অন্যতম সেরা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস নগদের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক