টেকসই উন্নয়নে দক্ষ জনগোষ্ঠীর গুরুত্ব অপরিসীম

সেলিনা আক্তার: আমাদের সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার মাঝেও অমিত সম্ভাবনা রয়েছে, যা দেশকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এজন্য চাই বৈশ্বিক ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সময়োপযোগী সুদূরপ্রসারী সঠিক পরিকল্পনা ও তার যথার্থ বাস্তবায়ন। ১১ জুলাই ছিল বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। অপুষ্টি, অপর্যাপ্ত শিক্ষার সুযোগ, বেকারত্ব, চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা প্রভৃৃতি সমস্যার মূলে রয়েছে অতিরিক্ত জনসংখ্যা। মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এবারও বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হয়েছে। এ বছর দিবসটির পতিপাদ্য হলো-A world of 8 billion: Towards a resilient future for all-Harnessing opportunities and ensuring rights and choices  for all.  যার ভাবার্থ করা হয়েছে-‘৮০০ কোটির পৃথিবী: সকলের সুযোগ, পছন্দ ও অধিকার নিশ্চিত করে প্রাণবন্ত ভবিষ্যৎ গড়ি’। ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে উন্নীত হয়। এর ফলে ইউএনডিপি’র গভর্ন্যান্স কাউন্সিল প্রতি বছর দিনটিকে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত হয়।

জনসংখ্যা কোনো দেশের জন্য সম্পদ আবার কোনো দেশের জন্য বোঝা। কোনো কোনো দেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা না করে বোঝা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে প্রযুক্তি ও উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে অতিরিক্ত জনসংখ্যা দক্ষ করতে পারলে তা সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় অপুষ্টি, পর্যাপ্ত শিক্ষার অভাব, বেকারত্ব, চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতার মূলে রয়েছে অতিরিক্ত জনসংখ্যা। আর এসব বিষয়কে সামনে রেখে জনসংখ্যা বিষয়ক সমস্যাগুলো সবাইকে অবহিত করা এবং তা গুরুত্ব সহকারে সমাধানের প্রচেষ্টা করাই হলো দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য।

বাংলাদেশে তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশের আয়তনের দিক দিয়ে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি। দেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন চাহিদা ও উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে প্রতিনিয়ত ভূমি, পানিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর মাত্রারিক্ত চাপ পড়ছে। যার ফলশ্রুতিতে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে জানমালের ক্ষতিসহ উন্নয়ন ও অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। 

স্বাধীনতার পর ধ্বংসস্তূপ থেকেই দেশটির পথচলা শুরু। ছিল না অবকাঠামো, ছিল না কোনো প্রতিষ্ঠানও। স্বাধীনতার পর থেকে অজগ্র বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। এক সময় বিশ্বে দুর্ভিক্ষে জর্জরিত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল, যা এখন ইতিহাস। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক। সামাজিক উন্নয়ন সূচকগুলোতে বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশের। যেমন শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার হার বেড়েছে অনেক। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় প্রকৃত অর্থে তিনগুণ বেড়েছে, আর গড় আয়ু ১৯৭১-১৯৭২ সালের ৪৭ বছর থেকে ২০২১ সালে ৭২.০৮ বছরে উন্নীত হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে।

আমাদেও দেশে মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ০৪ শতাংশ, প্রতি হাজারে মাতৃমৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনসংখ্যার শিক্ষার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ, ৭ বছর ও তদূর্ধ্ব জনসংখ্যার শিক্ষার হার ৭৫ দশমিক ২ শতাংশ, ৭ বছর ও তদূর্ধ্ব নারী শিক্ষার হার ৭২ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া দেশের ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনসংখ্যার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর হার ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ এবং নারী ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ।

জনসংখ্যার বিচারে আমাদেও দেশ অষ্টম স্থানে রয়েছে। কোথাও কোথাও আবার নবমও উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব–্যরো অব স্ট্যাটিসটিকসের (বিবিএস) হিসেবে আমাদের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি এবং বিশ্বের জনসংখ্যা ৭৮০ কোটি। আমাদের দেশের সীমিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশের জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করতে হবে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশন (ডব্লিউএইচও)-এর হিসাব মতে, প্রতি মিনিটে ২৫০টি শিশু জš§গ্রহণ করে আর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে ১০টি শিশু। এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে জন্মগ্রহণকারী ১০০ জন শিশুর মধ্যে ৯৭ জন জন্মগ্রহণ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। এমনিতেই দেশগুলো অধিক জনসংখ্যার দেশ। সেদিক থেকে বিশ্বের অনেক দেশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশকে এখন রোল মডেল বলে মনে করে। বাংলাদেশ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম জিডিপি অর্জনকারী দেশ। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। করোনা সংকটে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। বিবিএস’র হিসেবে এরই মধ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।

বাংলাদেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে জনশক্তিকে আরও দক্ষ করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তরুণ যুব বেকারদের বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে তাদের কাজে লাগাতে হবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সিংহভাগ অঞ্চলের মাটিই উর্বর ও আবাদযোগ্য। তাই আমাদের কৃষিক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে উৎপাদন বৃদ্ধি করা আমাদের জন্য সহজ। কৃষি, খাদ্য এবং জš§নিরোধে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। কৃষিকে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিও চালিকাশক্তি বলা হচ্ছে। দেশে কম বেশি ৮০০ থেকে ৯০০ কোম্পানি নিজস্ব উদ্যোগে সফটওয়্যার তৈরি করে রপ্তানি করছে। পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল ও সুযোগ-সুবিধা পেলে সফটওয়্যার রপ্তানিও তৈরি পোশাকের মতো বেকারত্ব দূর করে দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে বলে আশা করা যায়। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে ১৫ বছর থেকে ৬০ বছর বয়সের মানুষ বেশি, যারা কর্মক্ষম। দেশের বিশাল জনসংখ্যাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদ, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। শুধু তাই নয়, জনশক্তি রপ্তানির প্রক্রিয়া সহজিকরণসহ সহজশর্তে ঋণের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। যার জন্য দরকার সঠিক কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।

জনসংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে রয়েছে উন্নয়নের সরাসরি সম্পর্ক। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। পরিবার পরিকল্পনা একটি প্রযুক্তি, যেখানে উন্নয়নের পূর্বশর্তকে বিবেচনায় রেখে সব বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে এটি মানবতার কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। কায়রো সম্মেলনে (১৯৯৪) জনসংখ্যা ও স্থিতিযোগ্য উন্নয়নের অব্যাহত ধারা বজায় রাখার লক্ষ্যে পরিবার-পরিকল্পনা কর্মসূচিতে উন্নয়নধর্মী বিভিন্ন কার্যক্রমকে সম্পৃক্ত করা হয়েছেÑযার মধ্যে আছে স্বাস্থ্য, চাকরি এবং জনগণের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান।

বাংলাদেশে জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করেন। সে আলোকে ১৯৭৬ সালে প্রণীত হয় জাতীয় জনসংখ্যানীতি।

পরিবার পরিকল্পনা খাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রম বাস্তবায়নে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সেবাসমূহ জনগণের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি কেন্দ্র, বিভাগ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন তথা গ্রাম পর্যায়ে সর্বত্র এখন ডিজিটাল সেবার আওতাধীন। পরিবার পরিকল্পনা হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য একটি বিনিয়োগ এবং সব উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য একটি মৌলিক ও মুখ্য এজেন্ডা।   

কভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। আর সেই জন্যই আমাদের সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে জনসংখ্যা জনসম্পদে রূপান্তর করা সহজ হবে। টেকসই উন্নয়নে পরিকল্পিত ও দক্ষ জনসংখ্যার গুরুত্ব অপরিসীম। সরকারি-বেসরকারিভাবে আমরা যদি উন্নয়নের স্বার্থে সুপরিকল্পিতভাবে সুসংবদ্ধ, সুসংকল্পবদ্ধ, দৃঢ় প্রত্যয়ী ও কঠোর পরিশ্রমী হতে পারি তবে জনশক্তি দিয়েই আমাদের সাফল্য নিশ্চিত।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০