আফরোজা নাইচ রিমা: হাত ধোয়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মূলত হাত ধোয়ার মাধ্যমে ব্যক্তির ইন্দ্রিয়ের কলুষতা দূর করার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের এবং দেশের কল্যাণ সাধিত হয়; যা কিছু অপ্রীতিকর, কুৎসিত আমাদের ইন্দ্রিয়ের কাছে তা অপ্রীতিকর এবং অগ্রহণীয়। তাই, সচেতনভাবে কভিড-১৯ প্রতিরোধে হাত ধোয়া একমুখী বার্তা হিসেবে নয়, বহুমুখী প্রচার ও প্রায়োগিক ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
মানবদেহের বেশি ব্যবহƒত অঙ্গ হাত। দৈনন্দিন কাজে হাতের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। এজন্য বিশ্বব্যাপী করোনাসহ অন্যান্য ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। ফলে চলতি মহামারি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরার পাশাপাশি সংক্রমণ থেকে প্রত্যেকের সুরক্ষায় বারবার সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া ও হ্যান্ড স্যানিটাইজের পরামর্শ দিয়েছেন। ভাইরাসটি প্রতিরোধে এখন কার্যকর ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক তৈরি হলেও করোনাকালে জনসাধারণের মধ্যে হাত ধোয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
বাংলাদেশের মানুষ আগের চেয়ে বর্তমানে বিশেষ করে করোনাকালে হাত ধোয়ার প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। মিকস (বহু নির্দেশক গুচ্ছ জরিপ) জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১২-১৩ সালে সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ। ২০১৯ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৪ দশমিক ৮ শতাংশ। বর্তমানে ২৫ শতাংশেরও কম লোক হাত ধোয় না। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, হাতে নোংরা বা ময়লা দেখা গেলে সাবান পানি দিয়ে ধুতে হবে। হাতের ময়লা দেখা না গেলে অ্যালকোহলসমৃদ্ধ হ্যান্ড রাব (হ্যান্ড স্যানিটাইজার) অথবা সাবান পানি দিয়ে বারবার হাত ধুতে হবে।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৬ (এসডিজি-৬)-এ সবার জন্য নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশন নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে নেয়া হচ্ছে বিভিন্ন উদ্যোগ। নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায় বাংলাদেশ যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। খোলা স্থানে মলত্যাগের হার প্রায় শূন্যের কোঠায় এসেছে, যা সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে।
আগে মানুষ পুকুর থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করলেও এখন অধিকাংশ মানুষ নলকূপ থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করে। এ ক্ষেত্রে ৯৭ শতাংশ সফল হয়েছে বাংলাদেশ। সহগ্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এমজিডি) ব্যাপক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টেকসই উন্নয়নে বাংলাদেশের অর্জনের জন্য ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলুশন নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন), গ্লোবাল মাস্টার্স অব ডেভেলপমেন্ট প্র্যাকটিস এবং যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউট ও সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট যৌথভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ পুরস্কার দেয়।
এসডিজির একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হলো ‘ইনক্লুশন ফর অল’। অর্থাৎ কাউকে বাদ দেয়া যাবে না। এজন্য প্রত্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চল, চর, হাওর, পাহাড়ি এলাকা, শহরের বস্তিবাসী ও নি¤œ আয়ের মানুষের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। পিছিয়ে পড়া সবাইকে নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনের আওতায় আনার জন্য। শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবার মধ্যে সচেতনতাও সৃষ্টি করা জরুরি।
হাত ধোয়া হোক জীবনাচরণের একটা অংশ। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে হাত ধোয়াকে বিচ্ছিন্ন না মনে করে দৈনন্দিন জীবনে অন্তর্ভুক্তিমূলক চর্চা মেনে নিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী, ৬টি ধাপে হাত ধোয়ার পরামর্শ প্রদান করেছে। মূলত প্রথমে পরিষ্কার পানিতে হাত ভিজিয়ে নিয়ে হাতের পিঠ, তালু ও আঙুলে পরিমাণমতো সাবান ঘষে নিয়ে, অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ঘষে নিতে হবে। এরপর দুই হাত একে অপরের সঙ্গে ভালো করে ঘষতে হবে এবং তারপর পরিষ্কার পানিতে হাত ধুয়ে নিতে হবে। পরিশেষে শুকনা কাপড় বা টিস্যু দিয়ে ভালো করে মুছে নিতে হবে।
এসডিজি ৬ অর্জনের সঙ্গে জড়িত সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে অনেক পরিকল্পনা আছে। নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন (ওয়াশ) খাতে সরকার নানাভাবে সহযোগিতা করে আসছে, যেখানে কিনা সবার জন্য নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন নিশ্চিত করা হচ্ছে, তেমনি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৬ নম্বর লক্ষ্যে গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবার সচেতনতা একান্ত প্রয়োজন, তবেই সার্থক হবে বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস। অধ্যাপক জধমহধৎ ঘঁৎশংব বলেন, ‘দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র হলো এমন কিছু শক্তির একত্রীকরণ, যেগুলো পরস্পরের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে একটি দেশকে দরিদ্র করে রাখে।’ যা দেশের উন্নয়নের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করে। ঠিক তেমনি হাত ধোয়াকে অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচির আওতায় না আনলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। কেননা, একটি সুস্থ জাতিই পারে একটি দেশকে দারিদ্র্য থেকে দূর করে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
পিআইডি নিবন্ধ