টেকসই জ্বালানিতে নতুন সংযোজন বর্জ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র

রকিবুল হুদা মজুমদার: টেকসই জ্বালানি বলতে এমন জ্বালানিকে বোঝানো হয় যা ভবিষ্যতের জ্বালানি সরবরাহ এবং সম্পদকে বিপন্ন না করে বর্তমান জ্বালানির চাহিদা পূরণ করতে পারে। আবার, টেকসই জ্বালানি হলো এমন একটি নতুন জ্বালানি মডেলে যা তিনটি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম: পরিবেশ সংরক্ষণ, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন।

ন্যদিকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ব্যবহার বা ভোগ করার পর যে অব্যবহারযোগ্য আবর্জনা তৈরি হয় সেগুলিকে বর্জ্য পদার্থ বলে। বর্জ্য দূষিত করছে পানি ও পরিবেশ। দেশের নদী-নালা, খাল-বিলগুলোর দিকে তাকালেই এর পরিধি ও তীব্রতা দেখা যায়। শহরগুলোতে যার অবস্থা আরও ভয়াবহ, ঢাকা শহরকে ঘিরে থাকা নদীগুলো যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

অতএব টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থার জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করতে হবে; আর নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম একটি উৎস হচ্ছে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন। আধুনিকায়নের বাংলাদেশ যখন স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে সেখানে দেশের সামগ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে এখনও এক ছাতার নিচে আনা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোতে এখনও প্রায় সনাতন পদ্ধতিতেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অর্থাৎ বর্জ্যরে স্থানই হচ্ছে উš§ুক্ত স্থান ও জলাশয়।

বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগের সূত্রমতে, রাজধানীসহ সারাদেশে দৈনিক প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদিত হয় এর মধ্যে শুধু রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনেই দৈনিক সাড়ে ৭ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এসব বর্জ্য পরিবেশে মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে।

তাই দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি কমাতে ও বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্যে বর্জ্যকে বিকল্প পন্থায় ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে সাভারের আমিনবাজারে প্রায় ৩০ একর জায়গাজুড়ে দেশের প্রথম ইনসিনারেশন প্ল্যান্টের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে; যার ভূমি উন্নয়নও ইতোমধ্যে শেষের দিকে। আগামী বছরের অক্টোবরে বর্জ্য থেকে ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় সঞ্চালন লাইনে যুক্ত হবেÑ এমন পরিকল্পনা নিয়েই প্রকল্পের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে দৈনিক ৩ হাজার টন বর্জ্য সরবরাহ করা হবে। বর্জ্য সরবরাহ হবে বিনা মূল্যে। উৎপাদিত ৪২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পিডিবি চুক্তি মূল্য অনুযায়ী কিনে নেবে।

পাওয়ার সেলের সর্বশেষ তথ্যমতে, সরকারিভাবে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ হাজার ৭৩৮ মেগাওয়াট। সম্প্রতি ৩০ এপ্রিল ২০২৪ দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। এর বাইরে ভারতের আদানি থেকে আমদানি হচ্ছে প্রতিদিন অন্তত ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। রামপাল থেকে জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে আরও ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। নেপাল থেকে ৫০০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুতের পাশাপাশি জিটুজি ভিত্তিতে আরও ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের আমদানি হবে। আর এসবের মাধ্যমেই দেশে বিদ্যুতের সরবরাহ চলছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, জ্বালানি সংকটে দেশে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। তাই নতুন করে জোর দেয়া হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে। বাংলাদেশও জ্বালানি সংকট উত্তরণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প গৃহীত হয়েছে।
বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাভারের উদ্যোগটি নির্মাণাধীন প্রথম প্রকল্প হলেও এটিই শেষ নয়। স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে এ ধরনের ১১টি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সরকার চায়, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন এলাকায় দৈনিক উৎপাদিত প্রায় ১৭ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্যকে রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে দূষণরোধসহ সম্পদে রূপান্তর করতে। এতে একদিকে যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, অন্যদিকে পরিবেশের জন্য হুমকিতে থাকা বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনা হবে।

একটি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই নগর বা দেশ বিনির্মাণে এই ধরনের প্রকল্প অনেক কার্যকরী ও প্রশংসনীয়। তবে যেহেতু এই ধারণা বাংলাদেশে এখনও প্রতিষ্ঠিত নয়; তথাপি নতুন এই প্রকল্পেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি টেকসই সমাধান হিসেবে গড়তে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমনÑ
প্রথমত, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একেবারেই নতুন একটি ধারণা হলেও এই ধরনের উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে নতুন নয়। কয়েক বছর আগে এমনি একটি ৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বর্জ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্যোগ ঘটা করে উদ্বোধন হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ জেলার জালকুড়ি এলাকায়।

গ্রাহকদের কাছে মাত্র ৫ থেকে ৬ টাকায় বিদ্যুৎ বিক্রির লক্ষ্যে ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর এই বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। কিন্তু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চীনের কনসোর্টিয়াম অব ইউডি এনভায়রনমেন্টাল ইকুইপমেন্ট টেকনোলজি কোম্পানি লিমিটেড কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। অর্থাৎ এই ধরনের প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে এবং এর কাজ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে যেন প্রকল্প গ্রহণের পর বন্ধ বা দীর্ঘসূত্রতা তৈরি না হয়।

দ্বিতীয়ত, দেশের সম্পূর্ণ বর্জ্যকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় আনতে হলে সরকারের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ও উদ্যোগ নিতে হবে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য ১৪টি ও ছাত্রীদের জন্য নির্মিত পাঁচটি হলের বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংস্থাকেও এই ধরনের কাজে উদ্যোগী হতে হবে।

তৃতীয়ত, দেশের মোট উৎপাদিত বর্জ্যর একটি বড় অংশ হচ্ছে মেডিকেল বর্জ্য। দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক, ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে উৎপন্ন এই বর্জ্যও সাধারণ বর্জ্যরে সঙ্গে মিশে থাকে তাই এ জাতীয় মেডিকেল বর্জ্যকেও সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে।
সরকার যদিও ইতোমধ্যে মেডিকেল বর্জ্য হতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় একটি ইনসিনারেশন প্ল্যান্ট স্থাপন ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোবেশনে একটি নির্মাণ করতে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে। তবে তা মোট উৎপন্ন মেডিকেল বর্জ্যরে তুলনায় নগণ্য।

অপরদিকে, দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মেবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন, এয়ারকন্ডিশনার, ফটোকপি মেশিনসহ নানা ইলেকট্রনিক সামগ্রী নষ্ট হয়। কিন্তু ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের পরিবেশসম্মত ও আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় সেগুলো অন্যান্য গৃহস্থালি ময়লা-বর্জ্যরে সঙ্গে ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হয়।

এই ধরনের ই-বর্জ্যরে কারণে অপরিণত শিশুর জš§ নেয়া, ওজন কম হওয়া এবং মৃত শিশু জšে§র ঘটনাও ঘটছে। ই-বর্জ্যেের সিসা নবজাতকের স্নায়ুতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। শিশু বড় হলে শ্বাসতন্ত্র, থাইরয়েড জটিলতা, ক্যানসার ও হƒদরোগের মতো বড় রোগের জটিলতাও দেখা দিতে পারে। তাই ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

চতুর্থত, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে যেহেতু পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে তাই বিদ্যুতের দাম কিছুটা বেশি হলেও সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে ও বর্জ্য পোড়ানোর ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে।
পরিশেষে, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ২ দশমিক ২ শতাংশ নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ। দেশের শহরাঞ্চলে ১৯৯১ ও ২০০৪ সালে প্রতিদিন বর্জ্য উৎপাদিত হতো যথাক্রমে ৯ হাজার ৮৭৩ ও ১৬ হাজার ৩৮২ টন এবং মাথাপিছু বর্জ্য সৃষ্টির পরিমাণ ছিল ১৫০ টন। এই হারে বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়তে থাকলে ২০২৫ সালে তা দাঁড়াবে প্রতিদিন ৪৭ হাজার ৬৪ টন এবং মাথাপিছু উৎপাদন হবে ২২০ টন। তাই এই দেশের এই বিশাল বর্জ্যকে একটি টেকসই ব্যবস্থাপনায় আনতে হলে দেশের শহরাঞ্চলের বাইরেও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বর্জ্যকে সঠিক ও মানসম্পন্ন ব্যবস্থাপনার নিচে আনতে হবে যা হতে হবে পরিবেশবান্ধব, জনবান্ধব ও অর্থকরী।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ এখন ব্যক্তিজীবনের একটি অত্যাবশ্যকীয় চাহিদা। সরকারের আন্তরিকতায় পাওয়ার সেলের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এখন বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী শতভাগ (১০০ শতাংশ)। তাই দেশের বিপুল এই জনসংখ্যার বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ-ই সবচেয়ে যুতসই সমাধান। ইতোমধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অন্যতম উৎস সোলার সিস্টেম দেশে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে এবং জনবান্ধব হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই আগামী দিনের স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণে ও পরিবেশ দূষণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন এই বর্জ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রই হতে পারে একটি টেকসই সমাধান। আর সম্পূর্ণ বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় আশা করা যায় তা আমাদের বিদ্যুৎ খাতকে আরও শক্তিশালী করবে।

সহকারী গবেষক, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম)

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০