Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 8:59 pm

টেকসই প্রকল্পে ঋণ বিতরণে ব্যর্থ সরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো

নিজস্ব প্রতিবেদক: টেকসই ও সবুজ শিল্প খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণ কমে গেছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) সার্বিক ঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এ সময় বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণে সক্ষম হলেও পিছিয়ে রয়েছে সরকারি ও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের অন্তত ২০ শতাংশ টেকসই প্রকল্পে বিতরণ করতে হবে। আর সবুজ খাতে মোট মেয়াদি ঋণের পাঁচ শতাংশ ঋণ বিতরণের শর্ত রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই শিল্পের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে এ দুই খাতে অর্থায়ন বাড়াতে নীতিমালা জারি করে টার্গেট বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও আশানুরূপ ঋণ বিতরণ করতে পারছে না অনেক ব্যাংক। আর এ তালিকায় সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলো। এছাড়া বিশেষায়িত ও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে টেকসই ও সবুজ শিল্পে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ঋণ দিয়েছে ৮৮ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। এটি ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসের চেয়ে প্রায় দুই হাজার সাত কোটি টাকা কম। ওই তিন মাসে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতে ঋণ বিতরণ করেছিল ৯০ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। এ সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে ৮৫ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের শেষ তিন মাসের চেয়ে দুই হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা কম। একই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণ প্রায় ৪৮৩ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৩৫৯ কোটি টাকায়।

লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ সরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো: চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো টেকসই প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে এক হাজার ১৭৫ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের মাত্র ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকগুলো সবুজ খাতে ঋণ দিয়েছে ২৬০ কোটি টাকা, যা তাদের মেয়াদি ঋণের ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। এ সময়ে বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকগুলো টেকসই প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে দুই হাজার ৬৪২ কোটি টাকা, যা তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৮ দশমিক ০৫ শতাংশ। একই সময়ে সবুজ খাতে ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে মাত্র ৬২ লাখ টাকা, যা তাদের মেয়াদি ঋণের দশমিক ০৭ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময়ে বিদেশি ব্যাংকগুলো টেকসই খাতে বিতরণ করেছে পাঁচ হাজার ৯১ কোটি টাকা, যা তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। একই সময়ে বিদেশি ব্যাংকগুলো সবুজ খাতে ঋণ দিয়েছে ২০৩ কোটি টাকা, যা তাদের মেয়াদি ঋণের ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ।

ঋণ বিতরণে এগিয়ে বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান: ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে টেকসই খাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৬০ হাজার ৫২০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ। একই সময়ে সবুজ খাতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে চার হাজার ৪১৭ কোটি টাকা, যা তাদের মেয়াদি ঋণের ১৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এ সময়ে শরিয়াহ্ভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকগুলো টেকসই খাতে ঋণ দিয়েছে ১৫ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা, যা তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর সবুজ খাতে ইসলামী ব্যাংকগুলো দিয়েছে এক হাজার ৮৫ কোটি টাকা, যা তাদের মেয়াদি ঋণের ৯ দশমিক ২১ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি বছরের তিন মাসে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ বিতরণ করেছে তিন হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা, যা তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের ২৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। একই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সবুজ খাতে ঋণ দিয়েছে এক হাজার ২৭১ টাকা, যা তাদের মোট মেয়াদি ঋণের ২৭ দশমিক ৯০ শতাংশ।

গত বছরও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি: প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত, ইসলামি, বিদেশি ব্যাংকসহ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণে পিছিয়ে থাকায় ২০২৩ সালের পুরো সময়েও টেকসই শিল্পে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ হয়নি। গত বছর টেকসই খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণ হয়েছে এক লাখ ৯৭ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা, যা তাদের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০২২ সালে টেকসই খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের হার ছিল আরও কম, মাত্র ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আর ২০২১ সালে এই হার ছিল আরও নাজুক, মাত্র আট শতাংশ। তবে গত বছর সবুজ খাতে ঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে। ২০২৩ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে, ২০২২ সালে যা ছিল ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আর ২০২১ সালে এ খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছিল মাত্র তিন শতাংশের মতো।

টেকসই অর্থায়ন বলতে পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন, ঋণের গুণগত মান এবং কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখেÑএমন খাতে ঋণ বিতরণকে বোঝায়। টেকসই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কৃষি, সিএমএসএমই, পরিবেশবান্ধব কারখানা ও সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল প্রকল্প প্রভৃতি। অন্যদিকে সবুজ প্রকল্পে অর্থায়নের মূল উদ্দেশ্য হলোÑপরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখার পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎ, পানি ও কাগজের খরচ কমানোর উপযোগী প্রতিষ্ঠান ও কারখানাগুলোকে ধরা হয় সবুজ শিল্প হিসেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, টেকসই অর্থায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে ২০২১ সাল থেকে বিভিন্ন মানদণ্ডে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) টেকসই রেটিং বা মান প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিবছর ১০টি ব্যাংক ও পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এ রেটিংয়ে যুক্ত করা হচ্ছে। এই রেটিংয়ে জায়গা পাওয়ার অর্থ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসই ও সবুজ অর্থায়নে ভালো করছে।