সুমাইয়া আকতার: জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত কারণে প্রতি বছর কোনো না কোনো ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলে। চলতি বছরে সংঘটিত প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’-এর কারণে জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। ফলে মানুষ তাদের বসতবাড়ি ও মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ ও অসহায়। হারিয়ে যাচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষের কর্মসংস্থান এবং সর্বশেষ সম্বল ভিটেমাটিও। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও পটুয়াখালী জেলা প্রতি বছর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে। যেমন:
খুলনা: ঘুর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে উপকূলীয় খুলনার পাইকগাছা এলাকা তছনছ করে দিয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে উপজেলার বিভিন্ন পোল্ডারে ক্ষতিগ্রস্ত পাউবো’র বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রামে হু-হু করে লবণপানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে। এতে হাজার হাজার বিঘার চিংড়ি ঘের প্লাবিত হয়ে মাছ ভেসে গিয়ে কোটি কোটি টাকার মৎস্যসম্পদের ক্ষতি হয়েছে। বিশেষত, ২২নং পোল্ডারের তেলিখালী, কালিনগর, দারুণমল্লিকের বেড়িবাঁধ ভেঙে ১৫টি গ্রাম, ২১নং পোল্ডারের দেলুটি পূর্ব ও পশ্চিম পাড়া, জিরবুনিয়া সøুইসগেটসংলগ ১, ৩, ৪নং ওয়ার্ডের চারটি গ্রাম এবং ২০-এর ১নং পোল্ডারের পারমধুখালী প্রতিরক্ষা বাঁধ, চাকরিবাকরি বাঁধ এবং ২ ও ৩নং ওয়ার্ডের তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে খুলনার উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
ভোলা: এদিকে ভোলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা মনপুরায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডব চলছেই। প্রচণ্ড বাতাস ও মেঘনায় অতি জোয়ারের তোড়ে চার স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে চার-পাঁচ ফুট পানিতে ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। জোয়ারে ভেসে গেছে শতাধিক পুকুর ও ঘেরের মাছ। সর্বশেষ মনপুরায় দুই হাজার ২০০ মিটার বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়। বেড়িবাঁধ ভেঙে ও জোয়ারের পানিতে হাজিরহাট ইউনিয়নের দাসের হাট, চর মরিয়ম, সোনারচর, চরজ্ঞান ও চরযতিন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অপরদিকে ৪নং দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের রহমানপুর ও দক্ষিণ সাকুচিয়া গ্রাম প্লাবিত হয়। এছাড়া মনপুরা ইউনিয়নের পূর্ব আন্দিরপাড় গ্রাম ও পশ্চিম আন্দিরপাড় গ্রাম প্লাবিত হয়।
বরগুনা: এরপর বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী উপকূলীয় জেলা বরগুনার বামনা উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেছে সমগ্র উপজেলা। বিষখালী নদীর জোয়ারের তোড়ে উপজেলার সব বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে উপজেলার চেঁচান, পুরাতন বামনা, খোলপটুয়া, দক্ষিণ রামনা ও চলাভাঙ্গা এলাকার বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কোনো কোনো বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে।
সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালী পয়েন্টে ধসে যায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ। উপকূলীয় এলাকায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ না থাকার কারণে ২০০৯ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আইলায় এই এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয় বলে উল্লেখ করে ভুক্তভোগীরা বলেন, কয়েক বছর সাগরের লোনাপানিতে বন্দি থাকতে হয় হাজার হাজার পরিবারকে। এ সময় টিকতে না পেরে শত শত মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে অন্য এলাকায় চলে গেছে। ষাটের দশকের বেড়িবাঁধ প্রায় অর্ধশত বছর ধরে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। এ কারণে সামান্য ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের কথা শুনলেই আঁতকে ওঠে উপকূলের মানুষ। তারা ঝড়কে ভয় পায় না, উপকূলের মানুষ ভয় পায় বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হওয়াকে।
পটুয়াখালী: পটুয়াখালীর বাউফল উপেজলার কালাইয়া-ভরিপাশা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও সড়কের ছয়টি স্থান পানি ঢুকে প্লাবিত হয় বিভিন্ন এলাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রাথমিকভাবে সাড়ে ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে। বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে জোয়ারের পানি প্লাবিত হয়ে বাড়িঘর, মাঠঘাট ও ফসলি ক্ষেত তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন বলইকাঠি, উত্তর বাদুরা ও পূর্ব আউলিয়াপুরÑএই তিন গ্রামের বাসিন্দারা। এছাড়া গলাচিপা উপজেলার চরবিশ্বাস ইউনিয়নের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ৫৫/৩ পোল্ডারের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকলেও গতকাল দুপুরের জোয়ারে তা সম্পূর্ণ ভেঙে জোয়ারের পানি পূর্ব চরবিশ্বাসের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জেলায় বেড়িবাঁধ রয়েছে এক হাজার ৮১৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৮ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে জোয়ারের জলোচ্ছ্বাসে বিভিন্ন অংশে অন্তত ১২ দশমিক ৫০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধ উপচে জোয়ারের পানিতে লোকালয় প্লাবিত হচ্ছে।
তবে সামগ্রিকভাবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ও অতিবৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক। বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে লবণপানিতে ফসলের মাঠ ও গ্রীষ্মকালীন সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। আর্থিক ক্ষতিতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক। এছাড়া ভেসে গেছে চিংড়ির ঘের, ভেঙে গেছে কাঁচা ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলের ক্ষেত, উপড়ে গেছে বহু গাছ। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক এলাকা। সড়কের দুপাশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড ভেঙে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সর্বোপরি উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই বেড়িবাঁধ সংস্কার এবং ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে বেড়িবাঁধ তৈরি করা বর্তমান সময়ের দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ের সম্ভাব্য ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবিদার। অতিদ্রুতই টেকসই বেড়িবাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে তৎপরতা অবলম্বন করতে হবে। পাশাপাশি উপকূলের মানুষকে জিম্মি করে বাঁধ ভাঙার আশায় থাকা একশ্রেণির অসাধু জনপ্রতিনিধি ও ঠিকাদারেরা বাঁধ মেরামতের নামে তারা লাখ লাখ টাকা লোপাট করেন, সেদিকেও কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়াতে হবে। এরই মধ্যে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জোরালো দাবিতে ‘ত্রাণ নয়, ভিক্ষা নয়, সেøাগানে যৌথভাবে মানববন্ধন করে খুলনা ব্লাড ব্যাংক ও খুলনা ফুড ব্যাংক। দুটি মানববন্ধন আয়োজন করে ‘দক্ষিণবঙ্গ স্বেচ্ছাসেবী ঐক্য পরিষদ’। তাছাড়া উপকূলীয় এলাকায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ না থাকায় ক্রমেই মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ দ্রুত মেরামতের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিৎ কর্মকার জানান, একনেক সভায় মোট ১১ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ১৪ হাজার ৩৩৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ছয় হাজার ৫৪১ কোটি ৫২ লাখ টাকা, বৈদেশিক ঋণ সহায়তা থেকে সাত হাজার ৮৭৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থা থেকে ৮৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং একইসঙ্গে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমন্বিতভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। তাই এই সাধারণ উপকূলবর্তী এলাকার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ঘোচাতে এবং জীবিকা নির্বাহ করার পথকে সুগম করার লক্ষ্যে টেকসই বেড়িবাঁধ উন্নয়ন এখন মৌলিক চাহিদাতুল্য।
শিক্ষার্থী
বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজ