Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 5:18 am

টোল দিয়ে চলতে হবে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মহাসড়কে

ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতুর সঙ্গে রাজধানী ও দক্ষিণাঞ্চলের দ্রুত যোগাযোগ গড়ে তুলতে চার লেন করা হচ্ছে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক। বর্তমানে এটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মহাসড়ক। আর এ মহাসড়কটি ব্যবহারে আরোপ করা হবে টোল। ফলে পদ্মা সেতু ও মহাসড়কটিতে যানবাহন চলাচলে পৃথক টোল দিতে হবে। যদিও বর্তমানে এ মহাসড়কে বিনা টোলেই যানবাহন চলাচল করে।

সম্প্রতি ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেন প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় বিষয়টি উঠে আসে। সময় সাশ্রয়ের জন্য এক্ষেত্রে পদ্মা সেতু ও মহাসড়কটিতে সমন্বিত টোল প্লাজা চালু করা যায় কিনা, তা নিয়ে আলোচনা করা হয়।

তথ্যমতে, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা ৫৫ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয় ২০১৬ সালের মে মাসে। সে সময় এর ব্যয় ছিল ছয় হাজার ২৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। যদিও অনুমোদনের ছয় মাসের মধ্যেই তা আরও ৬০০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। সর্বশেষ এ ব্যয় বাড়িয়ে ১০ হাজার ৮৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ১৮৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, আগে যা ব্যয় ছিল ১২৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

গত ১৪ মার্চ প্রকল্পটির স্টিয়ারিং কমিটির সভা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি) অনুষ্ঠিত হয়। এতে বলা হয়, প্রস্তাবিত মহাসড়কটিতে দুটি টোল প্লাজার সংস্থান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে নির্মাণাধীন পদ্মা বহুমুখী সেতুর টোল প্লাজা রয়েছে। সময় সাশ্রয়ের নিমিত্তে একটি সমন্বিত টোল প্লাজা করা যায় কিনা, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামত নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে থাকা প্রয়োজন। এছাড়া কার্ড পাঞ্চ বা ইলেকট্রনিক টোল কালেকশন সুবিধার মাধ্যমে টোল আদায়ের ব্যবস্থা করা যায় কিনা, সে বিষয়ে মতামত প্রদান করতে হবে।

টোল সড়ক হওয়ায় এটির দুই পাশ উম্মুক্ত থাকবে না। তাই বৈঠকে বলা হয়, মহাসড়কটির দুই পাশের জনগণকে একপাশ থেকে অন্য পাশে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ রাখা দরকার। এছাড়া পূর্ব-পশ্চিম ধোলাইপাড় এলাকার জনগণের সহজে যাতায়াতের জন্য ধোলাইপাড়ের শেষ প্রান্ত ও সড়কের শুরুর অংশে একটি ইন্টারসেকশন রাখা প্রয়োজন। বিষয়গুলো যাচাই-বাছাইপূর্বক মতামত প্রদানের সুপারিশ করা হয়। এছাড়া বর্ধিত সময়ে কাজ শেষ হবে কিনা, তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি কাজের গুণগত মান নিশ্চিতের সুপারিশও করা হয়। শিগগিরই এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে আইএমইডিতে জমা দিতে বলা হয়।

এদিকে প্রকল্পটির ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবে বিভিন্ন অংশের প্রস্তাবিত ব্যয় প্রাক্কলন যথাযথ হয়েছে কিনা, তার বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করার সুপারিশও করা হয়। সূত্রমতে, প্রকল্পটির ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবে ছয়টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলোÑপ্রকল্পের কর্ম পরিধি বৃদ্ধি, ম্যাটেরিয়ালের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি, ফাউন্ডেশন ও মাটির সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত অর্থবরাদ্দ, ১৩ শতাংশ আয়কর ও ভ্যাট, জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং ইউটিলিটি (পরিষেবা সংযোগ লাইন) প্রতিস্থাপন খাতে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা।

এতে আরও বলা হয়, প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটিতে ৬০ দশমিক ৩৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করার কথা ছিল। তবে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০ একর। এর মধ্যে ২১ দশমিক ১১ একর বেসরকারি খাত ও আট দশমিক ৩৬ একর সরকারি অন্যান্য বিভাগ থেকে স্থানান্তর করা হবে। যদিও জমি অধিগ্রহণ খাতে বরাদ্দ ছিল ৭৫০ কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়াবে এক হাজার ১৯৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এতে ৪৪৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন হবে।

এদিকে ইউলিটি সংস্থাগুলো বরাদ্দ ছাড়াই তাদের সংযোগ লাইন স্থানান্তর করছে। এ খাতে বরাদ্দ দরকার। এছাড়া প্রকল্পটিতে থাকা ভাঙ্গা বাস টার্মিনাল স্থানান্তর করতে হবে। এর বাইরে পদ্মা সংযোগ সড়কে সেতুটির জন্য মাওয়া ও ভাঙায় দুটি টোল প্লাজার ব্যবস্থা রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মহাসড়কটিতে পৃথক টোল প্লাজা নির্মাণ করতে হবে। এজন্যও বরাদ্দ দরকার।

জানতে চাইলে সওজের প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান শেয়ার বিজকে বলেন, প্রকল্পটির কাজের পরিধি বেড়ে গেছে। এতে জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বাড়াতে হয়েছে। এজন্য খাতটির ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যয়ও বাড়ছে। এছাড়া আয়কর, ভ্যাটসহ নতুন কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে। মাটির সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হয়েছে। পাশাপাশি নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যয় তা নতুন করে প্রকল্পটিতে যুক্ত হয়েছে। আর টোল সড়ক হলেও স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য পৃথক সার্ভিস লেন থাকবে। সেগুলো দিয়ে বিনা টোলে যানবাহন চলাচল করতে পারবে।

প্রসঙ্গত, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেন নির্মাণে ২০১৫ সালের অক্টোবরে ব্যয় ধরা হয় পাঁচ হাজার ২৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তবে অনুমোদনের আগেও দুই দফা বাড়ানো হয় প্রকল্প। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনকালে প্রকল্পটির ব্যয় দাঁড়ায় ছয় হাজার ২৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। পরে জমি অধিগ্রহণ ব্যয় বৃদ্ধির যুক্তিতে তা বেড়ে হয় ছয় হাজার ৮৫২ কোটি ২৮ লাখ টাকা। আর এবার ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ১০ হাজার ৮৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে চলমান ও নতুন বিভিন্ন চার লেন প্রকল্পের কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় জানতে চায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। এজন্য সংসদীয় কমিটিতে জমা দেওয়া সওজের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রস্তাবিত এলেঙ্গা-রংপুর চার লেন প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আর ২০১৫ সালে শুরু হওয়া জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইল হয়ে এলেঙ্গা চার লেনে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হচ্ছে ৪৮ কোটি ছয় লাখ টাকা। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনে কিলোমিটারপ্রতি গড় ব্যয় ১৯ কোটি ৮৫ লাখ ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পে ২০ কোটি ৮২ লাখ টাকা।

এতে আরও বলা হয়, ইউরোপে চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ২৮ কোটি টাকা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ ব্যয় ১০ কোটি টাকা। আর চীনে তা গড়ে ১৩ কোটি টাকা। ফলে কিলোমিটারপ্রতি হিসাবে ঢাকা-মাওয়া চার লেন বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মহাসড়ক।