বীর সাহাবী: বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচাতে ট্যানারি কারখানাগুলোকে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হলেও নদীদূষণ কমেনি। আগে শুধু বুড়িগঙ্গা দূষিত হলেও এখন বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী দুটি নদীই দূষণের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর।
জানা যায়, ২০০৩ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলোকে সরিয়ে সাভারে নেয়ার প্রকল্প হাতে নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। দীর্ঘদিন গড়িমসির পর ২০১৭ সালে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ট্যানারিগুলোকে সাভারে যেতে বাধ্য করা হয়। সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা গ্রামের ধলেশ্বরী নদীর পাশে ১১৯ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) চামড়া শিল্প এলাকা।
ট্যানারি কারখানাগুলো সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হলেও নদীদূষণ কমেনি, বরং দূষণের এলাকা আরও বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্যানারিতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) পর্যাপ্ত শোধন করতে না পারার কারণে নদীদূষণ বন্ধ হচ্ছে না।
একসময় ধলেশ্বরী নদীর পানি ছিল সুপেয়। কিন্তু বর্তমানে এই পানির দশাও বুড়িগঙ্গার মতোই হচ্ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। সরকারি তদারকি ও নজরদারির অভাব এবং নিয়ম অমান্য করে এখানেও শুরু হয়েছে নদীদূষণ। ট্যানারির বর্জ্য পরিশোধন না করে সরাসরি ও আংশিক পরিশোধিত বর্জ্যরে ড্রেনেজের লাইন সংযুক্ত করা হয়েছে নদীর জলধারায়। এ কারণে ধলেশ্বরী নদী দূষিত হচ্ছে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বুড়িগঙ্গা নদী বাঁচাতে ট্যানারি স্থানান্তর করা হয়েছে, কিন্তু সেখানেও তদারকির অভাবে আরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। ধলেশ্বরী নদীর আশেপাশের জমিতে চাষ করা যাচ্ছে না। পরিবেশবাদী সংগঠকরা বলছেন, পরিবেশনীতির বিষয়গুলো তোয়াক্কা না করায় দূষিত হচ্ছে চারটি নদীর পানি।
পরিবেশ দূষণ বেড়েছে: কারখানাগুলো সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হলেও নদীদূষণ কমেনি, বরং দূষণের এলাকা আরও বেড়েছে বলে জানিয়ে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, ‘ট্যানারিগুলোকে হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুর নিয়ে গেলাম। তাতে কি আমরা দূষণের মাত্রা কমালাম, নাকি আরও ছড়িয়ে দিলাম? আমরা ট্যানারি শিল্পকে ধ্বংস হতে দিতে চাই না। আমরা চাই দূষণ বন্ধ করে পরিবেশসম্মতভাবে এই শিল্পের কলেবর আরও বাড়–ক।’
তিনি বলেন, ‘সিইটিপি সক্ষমতা রয়েছে ২৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পরিশোধন করার, সেখানে কোরবানির মৌসুমে বর্জ্য উৎপাদিত হয় প্রায় ৪০ হাজার ঘনমিটার। তাহলে বাড়তি এই বর্জ্য কীভাবে পরিশোধন করা হবে?’
সরেজমিন দেখা গেছে, বিসিক চামড়াশিল্পের ভেতরে অনেকগুলো ফ্যাক্টরি মেরামত করে ঠিক করা হচ্ছে। বিসিকের বাইরেও অনেক ফ্যাক্টরি নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। কোরবানিকে সামনে রেখে আবার ঘুরে দাঁড়াবার আশায় এগুলোকে সংস্কার করছেন বলে জানিয়েছেন সেখানকার একাধিক ফ্যাক্টরি মালিক।
একজন ফ্যাক্টরি মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে এনে শেষ করে দেয়া হয়েছে। আমাদের যেসব কথা বলে এখানে আনা হয়েছিল, তার কোনোটাই এত বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আমাদের ব্যবসা ধ্বংস করে দিয়েছে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে অনেক কষ্ট হবে। এলাকাবাসী বলছেন, এই নদীতে ট্যানারির বর্জ্য ফেলার কারণে পানি দূষিত হচ্ছে। ফলে নদীকে ঘিরে যেসব ফসলি জমি রয়েছে, সেগুলোতে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, নিঃসন্দেহে ট্যানারি শিল্প বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য প্রধান শিল্প। কিন্তু এজন্য পরিবেশকে ব্যাপক খেসারত দিতে হয়। তাই পরিকল্পিত শিল্প এলাকায় চামড়া শিল্প গড়ে তোলার জন্য আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন থেকে।
তিনি বলেন, ট্যানারির বর্জ্য যদি পরিশোধিত না হয়ে নদীতেই যায়, তাহলে স্থানান্তর করে লাভ কী? কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সেটাই দেখছি সাভারে। বুড়িগঙ্গা নদী বাঁচাতে গিয়ে আমরা ট্যানারি স্থানান্তর করে নিয়ে আসছি সাভারে। এখানে এক নদীর বদলে চার নদী ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা, বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ একই সঙ্গে দূষিত হচ্ছে, কারণ ধলেশ্বরীর সঙ্গে অন্য নদীর সম্পর্ক রয়েছে।
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি নাসিম মঞ্জুর শেয়ার বিজকে বলেন, ‘যখন থেকে রপ্তানি কমতে শুরু করেছে, তখন পৃথিবীজুড়েই ক্রয়ক্ষমতা একটা চাপের মধ্যে ছিল। এ সময়টায় অচামড়াজাত পণ্য সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা সবাই স্নিকার পরি। তাই বলা যায়, চামড়ার জুতার ডিমান্ড সারা পৃথিবীতেই কমেছে।’
সুনির্দিষ্ট জায়গায় ট্যানারি ফ্যাক্টরিগুলো স্থাপনের পরও এ খাত থেকে কাক্সিক্ষত রপ্তানি আয় আসছে না। রপ্তানি আয় বৃদ্ধির বদলে আরও কমছে। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয় ১১৩ কোটি ডলার। এরপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১১৬ কোটি ডলারে। তা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আরও বেড়ে হয় ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। পরের অর্থবছর থেকে রপ্তানি আয় কমতে শুরু করে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে রপ্তানি আয় কমে ১০৯ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ওই অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কম হয়েছে ২১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আরও ছয় শতাংশ কমে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে আয় দাঁড়ায় ১০২ কোটি ডলারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ আয় হতাশাজনকভাবে আরও কমে যায়। তখন চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয় ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ খাতটি থেকে আয় কমে যায় ২৭ শতাংশ।
নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ড. রফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সাভারের এ ট্যানারি আরও ভাটি এলাকায় হওয়া উচিত ছিল, যা আমরা পরিষদ সৃষ্টির আগে থেকেই বলে আসছি। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলার পর তারা বলেছে, সিইটিপি হলে কোনো দূষণ হবে না। এটা চালু হলে ডালিমের রসের মতো পানি পড়বে, যা পান করা যাবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা ভয়াবহ। ডালিমের রস তো দূরের কথা, এই পানির কারণে আশপাশের জমিগুলোতে চাষাবাদ হচ্ছে না। পাশাপাশি নদীর মাছও মারা যাচ্ছে।’
ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, আসন্ন কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি। যে যে জায়গায় আমাদের প্রস্তুতি নেয়া দরকার ছিল, সেগুলোতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। ময়লা পরিষ্কার করার যে ওভারহোলিং সেটা আমরা করেছি, যেসব পাম্প মেরামত করা দরকার আমরা সেগুলো মেরামত করেছি। ঈদকে সামনে রেখে যা যা করণীয় আমরা মোটামুটি সবই করেছি।’