নিজস্ব প্রতিবেদক: সাভারে ট্যানারি শিল্পে কর্মরত প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক আবাসন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ খাতের শ্রমিকদের গড় বেতন নয় হাজার টাকার মতো, যা দারিদ্র্যসীমার চেয়ে অনেক নিচে। হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর হলেও এই পুরো প্রকল্পে শ্রমিকদের বিষয়টি অবহেলিত রয়ে গেছে। ফলে সেখানে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক গবেষণায় এসব তথ্য জানা গেছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর বনানীতে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) মিলনায়তনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। পিআরআই’র চেয়ারম্যান জায়েদী সাত্তারের সভাপতিত্বে এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও সানেমের চেয়ারম্যান বজলুল হক খন্দকার। এতে মূল আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিষয়ের অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ। এছাড়া এ সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ট্যানারি মালিকদের সমিতি বিটিএ, ফুটওয়্যার উৎপাদন ও রফতানিকারকদের সমিতিসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
‘হাজারিবাগের ট্যানারিসমূহের ত্বরিত অনুসন্ধান’ শীর্ষক গবেষণায় ৪৫৫ ট্যানারি শ্রমিকের ওপর জরিপ চালানো হয়। এছাড়া ধাপে ধাপে হাজারিবাগ ও সাভারে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে ফল প্রকাশ করা হয়। এতে জানা যায়, সাভারে জীবনধারণের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে আবাসন, হাসপাতাল, স্কুল ও ক্যান্টিন সুবিধা স্থাপন না করেই ট্যানারি স্থাপন করা হয়েছে। শ্রমিকদের ৯২ শতাংশ এ অভিযোগ করেছে। এছাড়া জুলাই-আগস্টের বেতনসহ ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি প্রায় ৯৫ শতাংশ শ্রমিক। সরকারের তরফে মালিকদের ২৫০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, যার অর্ধেক এরই মধ্যে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকদের জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ বা স্থানান্তরের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এ জন্য অবিলম্বে ১০৫ কোটি টাকা ব্যবস্থা করা জরুরি বলে এতে মত দেওয়া হয়। এছাড়া ট্যানারি স্থানান্তরের পর চাকরির নিশ্চয়তা এবং সাভার চামড়াশিল্প নগরীতে তাদের আবাসন ও চিকিৎসাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে আসছিল শ্রমিকরা।
এদিকে গবেষণায় ট্যানারি খাতের নানা সংকট উল্লেখ করে বলা হয়, বুড়িগঙ্গা রক্ষার জন্য হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি শিল্পকে সাভারে স্থানান্তর করা হলো, কিন্তু ট্যানারির বর্জ্যরে ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে সাভারের ধলেশ্বরী নদীটিরও বুড়িগঙ্গার ভাগ্য বরণের আশঙ্কা রয়েছে। ট্যানারির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সিইটিপি স্থাপন করা হলেও তা কাজ করছে না। রাতের অন্ধকারে বর্জ্যগুলো নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। তরল বর্জ্যরে জৈবিক ব্যবস্থাপনার জন্য সিইটিপি এখনও প্রস্তুত নয়। এছাড়া সলিড বর্জ্যরে জন্য সেখানে কোনো ব্যবস্থা নেই। এদিকে সিইটিপির ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের কোনো পরামর্শ মানছে না বলে অভিযোগ করেছেন সভায় উপস্থিত বক্তারা। গবেষণা প্রতিবেদনে বুয়েটের পরামর্শগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সভার সভাপতির বক্তব্যে অর্থনীতিবিদ জায়েদী সাত্তার বলেন, চামড়াশিল্প দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিমুখী শিল্প। এর সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা গেলে এ খাতকে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি অবস্থায় আনা সম্ভব, কারণ বৈশ্বিকভাবে তৈরি পোশাকের বাজার এবং চামড়াশিল্পের বাজার একই। অপর আলোচক অধ্যাপক আবু ইউসুফ বলেন, অনেক প্রচেষ্টার মাধ্যমে মালিকপক্ষ ও বিসিকের মধ্যে সমঝোতা করিয়ে ট্যানারিকে সাভারে নেওয়া হয়েছে। এটা একটা অগ্রগতি। কিন্তু একে কার্যকরভাবে লাগাতে না পারলে চামড়া খাত থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের রফতানি সম্ভব হবে না। তিনি আরও বলেন, একই সময় চামড়া খাতের বিকাশ শুরু করেও ভিয়েতনাম এখন এ খাতে ১০ বিলিয়নের বেশি রফতানি আয় করে। অথচ বাংলাদেশ এখনও এক বিলিয়নের কাছাকাছি আটকে আছে।
সভায় বুয়েটের প্রতিনিধি এ সময় বলেন, বাংলাদেশে প্রথম সিইটিপি প্রকল্প হচ্ছে সাভারের ট্যানারি শিল্পে। এটাতে আমাদের সফল হতে হবে। ঢাকার নদীগুলোর পানি বিশুদ্ধ করার জন্য সামনে ১০টি সিইটিপি স্থাপনের জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এটা করতে হলে আমাদের এই সিইটিপিকে সফল করতে হবে। এজন্য সবাই মিলে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা দরকার।