Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 11:35 pm

ট্যুরিস্ট ভিসায় কাজ করেন তিন প্রকল্পে, বিমানে টাকা বহন

রহমত রহমান: তিনি চীনা নাগরিক, বাংলাদেশে এসেছেন ট্যুরিস্ট ভিসায়। তাও একটি নয়, দুটি ভিসায়! ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারবেন না শর্ত থাকলেও, তিনি চাকরি নিয়েছেন তিনটি প্রকল্পে। একেক প্রকল্পের পদবি একেক রকম। বিমানে চড়েছেন ৬৪ লাখ টাকাভর্তি ব্রিফকেস নিয়ে। আকাশপথে নগদ টাকা বহন ‘রেড ফ্ল্যাগ’ হিসেবে গণ্য। তাই বিমান উড়ার কিছু সময় আগে বাদ সাধল কাস্টমস। টাকাসহ আটক হলেন কাস্টমসের হাতে।

আটক হয়ে প্রথমে জানালেন, এই টাকা একটি প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতার টাকা। যদিও তা প্রমাণ হয়নি। দিতে থাকলেন বিভ্রান্তিকর তথ্য। অভ্যন্তরীণ রুটে চাইনিজ এক নাগরিকের টাকা বহনে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের করা একটি অনুসন্ধানে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।

দীর্ঘদিন এক বছর ১০ মাসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো ট্যুরিস্ট ভিসায় এই চাইনিজ নাগরিকের বাংলাদেশে আসা, প্রকল্পে চাকরি। অভ্যন্তরীণ রুটে পাচারের উদ্দেশে টাকা বহন করা হচ্ছে কিনাÑতার প্রমাণ পাননি তদন্ত কর্মকর্তারা। তবে এই টাকা প্রকল্প থেকে ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে নেয়া হতে পারে। ঘুষ ও দুর্নীতির মতো সম্পৃক্ত অপরাধ থেকে উদ্ভূত মানি লন্ডারিং অনুসন্ধানের এখতিয়ার শুল্ক গোয়েন্দার নেই। সে জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দিয়ে তদন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ৫ নভেম্বর ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের বিএস-১০৮ ফ্লাইট। এই বিমানে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসতে টিকিট করেছেন চাইনিজ নাগরিক লিউ রংঝেং। সিভিল এভিয়েশনের দায়িত্বরতরা ওই যাত্রীর লাগেজ (ব্রিফকেস) স্ক্যানিং করে রীতিমতো হতবাক। কারণ লাগেজে রয়েছে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশি টাকা।

জিজ্ঞাসাবাদে মিস্টার লিউ জানান, ব্রিফকেসে ৬৪ লাখ টাকা রয়েছে। কীসের টাকা, কোথা থেকে এসেছেÑজিজ্ঞাসা করা হলে ওই চাইনিজ নাগরিক বিভ্রান্তিকর তথ্য দিতে থাকেন। টাকার পরিমাণ বেশি হওয়ায় বিষয়টি কাস্টমস ও বিভিন্ন সংস্থাকে জানায় সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। সে সময় দেশে ক্যাসিনো ব্যবসা ও অর্থ পাচার নিয়ে বেশ হইচই হচ্ছে। বিমানবন্দর কাস্টমস কর্মকর্তারা দেশের বিরাজমান এই পরিস্থিতিতে ৬৪ লাখ টাকা আটক করেন। কাস্টমস কর্মকর্তারা মিস্টার লিউ’র কাগজপত্র জব্দ করেন। তার থেকে লিখিত (অঙ্গীকারনামা) নেন, যাতে লিউ নিজেকে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রজেক্ট অফিস’-এর ‘টেকনিক্যাল ম্যানেজার’ হিসেবে উল্লেখ করেন। আকাশপথে নগদ টাকা বহন ‘রেড ফ্ল্যাগ’ হিসেবে গণ্য।

এছাড়া টাকা নিয়ে মিস্টার লিউ’র বিভ্রান্তিকর তথ্য নিয়ে বেকায়দায় পড়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। মানি লন্ডারিং হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দেয়। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আকাশপথে অভ্যন্তরীণ রুটে নগদ টাকা বহনে মানি লন্ডারিং হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে এনবিআর ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেয়। প্রায় এক বছর ১০ মাস তদন্ত শেষে শুল্ক গোয়েন্দা চলতি বছরের ৪ নভেম্বর এনবিআরকে প্রতিবেদন দেয়। তদন্ত করতে গিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও চাইনিজ ওই নাগরিকের কাণ্ডে হতবাক। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত দলিলাদি পর্যালোচনা করে অর্থ পাচারের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা পাননি কর্মকর্তারা। তবে ঘুষ ও দুর্নীতির মতো অপরাধের সঙ্গে প্রাপ্ত টাকার সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬৪ লাখ টাকার কোনো উৎস ও নগদ টাকা বহনের কারণ এবং যৌক্তিক কোনো দলিলাদি দিতে পারেনি। মিস্টার লিউ কাস্টমসের কাছে অঙ্গীকারনামায় নিজেকে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল, চায়না হারবারের ‘সাব কন্ট্রাক্টর’ এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রজেক্ট অফিসের ‘টেকনিক্যাল ম্যানেজার’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার ২০২০ সালের ৭ জুন লাকসাম-আখাউড়া ডুয়েলগেজ রেল প্রকল্পের এক চিঠিতে মিস্টার লিউকে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের ‘ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তিন প্রকল্পের ভিন্ন বক্তব্য, লিউ’র কর্মক্ষেত্র, লাগেজে বহন করা টাকার উৎস ও টাকা বহনের কারণ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

আটক করা ওই টাকা মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে চায়না হারবারের প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে মিস্টার লিউ অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করেছেন। যদিও তিনি চট্টগ্রাম থেকে টাকা নিয়ে ঢাকা আসছেন এবং ওই টাকা যে বেতন-ভাতার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। মিস্টার লিউ’র পরিচয় নিশ্চিত হওয়া ও আটক করা টাকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে শুল্ক গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট তিনটি প্রকল্পে চিঠি দেয়। এছাড়া মিস্টার লিউ’র বাংলাদেশে প্রবেশের তথ্য জানতে ইমিগ্রেশনকে চিঠি দেয়া হয়। একইসঙ্গে তিনটি প্রকল্প ও লিউ সম্পর্কে জানতে গুলশান ভ্যাট বিভাগ, বিএফআইইউ, আরজেএসসিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয়া হয়। সে অনুযায়ী তথ্য পেয়ে তা বিশ্লেষণ করেন কর্মকর্তারা।

তথ্যাদি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মিস্টার লিউ লাগেজে বহন করা টাকা প্রকল্পের নামে থাকা প্রাইম ব্যাংক বনানী শাখা থেকে ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে উত্তোলন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু তদন্তে দেখা গেছে, মিস্টার লিউ কোনো টাকা উত্তোলন করেননি। দুটি ব্যাংক হিসাব প্রকল্পের নামে অন্য কর্মকর্তা টাকা উত্তোলন করেছেন।

লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সর্বশেষ ১৪ আগস্ট ওই হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এর তিন মাস পর ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে কাস্টমস কর্মকর্তারা লিউ থেকে ওই টাকা আটক করেন। সেক্ষেত্রে ব্যাংক উত্তোলন করা সেই টাকা যে কাস্টমস আটক করেছে ওই টাকা, তার স্বপক্ষে মিস্টার লিউ বা প্রকল্প কর্মকর্তারা সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি। আবার মিস্টার লিউ তার অঙ্গীকারনামায় আটক করা টাকা ‘চায়না হারবার মিরসরাই অনৈতিক অঞ্চল’ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য লাগেজে ওই টাকা বহন করছেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড থেকে দাবি করা হয়েছে, ওই টাকা ‘দোহাজারী টু কক্সবাজার রামু প্রকল্প’-এর জন্য বহন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই প্রকল্পের কর্মকর্তারা সেই টাকার কোনো প্রমাণাদি দিতে পারেননি।

আরও দেখা গেছে, মিস্টার লিউ ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসেছেন। তার দুটি ট্যুরিস্ট ভিসা পাওয়া গেছে। ট্যুরিস্ট ভিসায় তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। ভিসা দুটিতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, ‘এমপ্লয়মেন্ট পেইড ওর আন-পেইড প্রহিবিটেড’। ভিসার শর্তানুযায়ী, মিস্টার লিউ বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠানে বা অন্য কোনোভাবে বাংলাদেশের কোথাও চাকরিতে নিযুক্ত হতে পারবেন না। এরপরও চাইনিজ এই নাগরিক কীভাবে প্রকল্পসমূহে নিয়োগ পেয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া একই ব্যক্তি কীভাবে দুটি ট্যুরিস্ট ভিসা পেয়েছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

অন্যদিকে, মিস্টার লিউকে নিযুক্ত করা চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তদন্তে দেখা গেছে, চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের চারটি মূসক নিবন্ধন নিয়েছে। এর মধ্যে দুটিতে ‘সার্ভিস’ হিসেবে, দুটিতে ‘সার্ভিস রেন্ডার’ হিসেবে নিবন্ধন নিয়েছে। ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট থেকে নিবন্ধন নেয়া হলেও, প্রতিষ্ঠানটি গত এক বছরে কোনো রিটার্ন (দাখিলপত্র) জমা দেয়নি। অথচ মূসক আইনে রিটার্ন জমা না দিলে মাসিক ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। গুলশান ভ্যাট বিভাগ এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এছাড়া লিমিটেড কোম্পানি হলেও প্রতিষ্ঠানটি আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নেয়নি।

শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদনে বলা হয়, মিস্টার লিউ’র বহন করা টাকা যদি চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের হয়ে থাকে, তাহলে তা ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হওয়া উচিত ছিল। কারণ দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নগদ অর্থ বহন ‘রেড ফ্ল্যাগ’ হিসেবে গণ্য হয়। আটক করা টাকা অভ্যন্তরীণ রুটে দেশ থেকে পাচারের উদ্দেশে বহন করা হচ্ছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে টাকার উৎস ও আকাশপথে কী কারণ বহন করা হচ্ছেÑতার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে মিস্টার লিউর ভিসা, তিনটি প্রকল্পে চাকরি, পদবি ও টাকা বহন নিয়ে পাওয়া তথ্যে ব্যাপক গরমিল পাওয়া গেছে। বহন করা টাকা প্রকল্পের ঘুষ ও দুর্নীতির টাকা হতে পারে, যা মানি লন্ডারিং আইন অনুযায়ী তদন্ত করা যায়। তবে শুল্ক গোয়েন্দার মানি লন্ডারিং আইনে ‘ঘুষ ও দুর্নীতির’ তদন্ত করার এখতিয়ার নেই। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বিষয়টি তদন্ত করার সুপারিশ করা হয়।