Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 1:03 am

ট্রান্স ফ্যাট ও হৃদরোগ ঝুঁকি

আয়নাল হোসেন: ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণ ও হৃদরোগ ঝুঁকির উচ্চহার ব্যাপকভাবে সম্পর্কযুক্ত। পৃথিবীব্যাপী মৃত্যুর একক কারণ হিসেবে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা হৃদরোগের অবস্থান শীর্ষে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর এক কোটি ৭৯ লাখ মানুষ হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করে (মোট মৃত্যুর ৩১ শতাংশ) এবং কেবল ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের কারণেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষ। বাংলাদেশে প্রতিবছর দুই লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগে মারা যায়, যার চার দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য দায়ী ট্রান্স ফ্যাট। উদ্বেগজনক বিষয় হলো হৃদরোগীদের করোনা সংক্রমণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি অনেকগুণ বেশি।       

ট্রান্স ফ্যাটের উৎস

ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেল (পাম, সয়াবিন ইত্যাদি) যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেশন করা হলে তেল তরল অবস্থা থেকে কঠিন আকার ধারণ করে, অর্থাৎ জমে যায়। এই প্রক্রিয়ায় ট্রান্স ফ্যাটও উৎপন্ন হয়। এছাড়া ভাজা-পোড়া খাদ্যে একই ভোজ্য তেল উচ্চ তাপমাত্রায় বারবার ব্যবহারের কারণেও খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাট সৃষ্টি হয়। তবে পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল বা পিএইচও ট্রান্স ফ্যাটের প্রধান উৎস। এই পিএইচও বাংলাদেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামে অধিক পরিচিত। ডব্লিওএইচও’র পরামর্শ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির দৈনিক ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের পরিমাণ হওয়া উচিত মোট খাদ্যশক্তির এক শতাংশের কম, অর্থাৎ দৈনিক দুই হাজার ক্যালোরির ডায়েটে তা হতে হবে দুই দশমিক দুই গ্রামের চেয়েও কম।

হৃদযন্ত্রের ওপর ট্রান্স ফ্যাটের প্রভাব

উচ্চমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) গ্রহণ হার্ট অ্যাটাকসহ হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ডব্লিওএইচও’র ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার মানুষ শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ট্রান্স ফ্যাট এক ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি বা আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যা রক্তে ‘খারাপ কোলেস্টেরল হিসেবে পরিচিত Low Density Lipoprotei বা এলডিএল বৃদ্ধি করে, অপরদিকে High Density Lipoprotein বা এইচডিএল কোলেস্টেরল (ভালো কোলেস্টেরল বলা হয়) কমিয়ে দেয়। এর ফলে রক্তবাহী ধমনীতে কোলেস্টেরল জমা হয়ে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের খাবারে ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি

ঢাকার পিএইচও নমুনার ৯২ শতাংশে ডব্লিউএইচও সুপারিশকৃত দুই শতাংশ মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্স ফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পাওয়া গেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে, যা ডব্লিউএইচও’র সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। ঢাকার শীর্ষস্থানীয় পিএইচও ব্র্যান্ডগুলোর নমুনা বিশ্লেষণ করে এই ফলাফল পেয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা। অন্য একটি গবেষণায় ঢাকার স্থানীয় বাজার থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে সংগৃহীত ১২ ধরনের বেকারি বিস্কুটের নমুনায় পাঁচ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে।

বাংলাদেশে ট্রান্স ফ্যাটের স্বাস্থ্যঝুঁকি

ট্রান্স ফ্যাটজনিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অতিসম্প্রতি ডব্লিউএইচও প্রকাশিত WHO Report on lobal Trans Fat Elimination ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর হৃদরোগে যত মানুষ মারা যায়, তার চার দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য দায়ী ট্রান্স ফ্যাট। ট্রান্স ফ্যাটের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো আইন বা নীতি নেই, তবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করেছে। কমিটির আওতায় এরই মধ্যে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণে একটি ধারণাপত্র তৈরি করা হয়েছে।

করণীয়

বাংলাদেশে হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডব্লিউএইচও’র পরামর্শ অনুযায়ী সব ধরনের ফ্যাট, তেল ও খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের দুই শতাংশ নির্ধারণ করে আইন প্রণয়ন এবং কার্যকর করা অত্যন্ত জরুরি। এর পাশাপাশি সহায়ক পদক্ষেপ হিসেবে প্রয়োজন মোড়কজাত খাবারের পুষ্টিতথ্য তালিকায় ট্রান্স ফ্যাটের সীমা উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা, উপকরণ তালিকায় পিএইচও’র মাত্রা উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা ও ফ্রন্ট অব প্যাকেজ লেবেলস বাধ্যতামূলক করা, যা খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি নির্দেশ করবে এবং ‘ট্রান্স ফ্যাট-মুক্ত’ বা ‘স্বল্পমাত্রার ট্রান্স ফ্যাট’ এ-জাতীয় স্বাস্থ্যবার্তা ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হলে হৃদরোগজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যু কাক্সিক্ষত মাত্রায় হ্রাস পাবে এবং অসংক্রামক রোগ-সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা তিন দশমিক চার অর্জন সহজতর হবে।