মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ: গতকাল রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, গুলিস্তানে ফুলবাড়ীয়া স্টপেজ, যাত্রাবাড়ী এলাকা, কাজলা পেট্রল পাম্প, রায়েরবাগের ইউনাইটেড পেট্রল পাম্প ঘুরে দেখা গেছে অসংখ্য বাস অলস দাঁড়িয়ে আছে। এসব বাসের কিছু কিছু লোকাল, আবার কিছু সিটিং সার্ভিস হিসেবে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। কিন্তু গত রোববার থেকে সারা দেশে পুলিশের বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ পালন শুরু হলে এ বাসগুলোর চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাসগুলোর ঠিকঠাক কাগজপত্র না থাকায় এগুলো চালানো বন্ধ রেখেছেন মালিক ও চালকরা।
যাত্রাবাড়ীতে কথা হয় কয়েকজন চালক ও হেলপারের সঙ্গে। রাসেল নামে এক বাসচালক জানান, তার নিজেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। তাই গাড়ি নিয়ে নামছেন না। রাসেল বলেন, আমাদের অনেকেই গাড়ি নিয়ে নামছেন না। কারও কারও গাড়ির কাগজ ঠিক নেই। কারও আবার ড্রাইভিং লাইসেন্সেরই ঠিক নেই। চলমান অভিযান শেষ হলে সবাই বাস নিয়ে নামবেন। এদিকে চলমান অভিযানের কারণে অনেক সিটিং সার্ভিসেরও স্বাভাবিকের চেয়ে কমসংখ্যক বাস চলাচল করছে। ফুলবাড়ীয়া বাস স্টপেজে গিয়ে দেখা যায় গুলিস্তান-আবদুল্লাহপুর রুটে চলাচলকারী ৩ নম্বর স্পেশাল সার্ভিসের বেশ কিছু বাস অলস দাঁড়িয়ে আছে। এ বিষয়ে এই বাস সার্ভিসের সুপারভাইজার রফিক মিয়া বলেন, কিছু কিছু বাসের কাগজপত্রে একটু সমস্যা আছে, তাই সেগুলো চলছে না। তবে যেগুলোর কোনো সমস্যা নেই, সেগুলো চলছে।
এমন চিত্র রাজধানীর প্রায় সবগুলো বাস সার্ভিসেরই। পুলিশের বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ শুরুর পর থেকে হঠাৎ রাজধানীতে কমে আসে গণপরিবহনের সংখ্যা। এতে ছাত্র আন্দোলন শেষ হলেও দুর্ভোগ থেকে যায় সাধারণ মানুষের। গত পাঁচ দিন রাজধানীর মিরপুর, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, পল্টন, মতিঝিল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে রাস্তায় আগের তুলনায় বাসের সংখ্যা কম। মোড়ে মোড়ে তাই অপেক্ষমাণ যাত্রীর সংখ্যা বেশি। একটি বাস এলেই তাতে ওঠার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন তারা। এ নিয়ে অবশ্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে নগরবাসীর মাঝে। অনেকেই এ ধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও কেউ কেই আবার রাতারাতি এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন। গতকাল পল্টন এলাকায় কথা হয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হেলাল খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, সব সময়ই এ ধরনের অভিযান চালু রাখা দরকার। এতে করে অদক্ষ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা বাস চালাতে পারবেন না। ফলে সড়কে শৃঙ্খলা বাড়বে আর আমরাও নিরাপদ বোধ করব।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা জয়নুল আবেদীন বলেন, লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি না চলায় রাস্তায় গাড়ির চাপ কম। বাস পেতে একটু কষ্ট হলেও এ ধরনের বাস বন্ধ করা উচিত। আর তেমন কোনো যানজট ছাড়া আরামেই চলাচল করা যাচ্ছে। আমরা চাই সব সময় রাস্তায় এ অবস্থা থাকুক। তবে দীর্ঘক্ষণ শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকেও উত্তরাগামী কোনো বাসে উঠতে না পেরে বিরক্ত মঞ্জুর হোসেন বলেন, এভাবে হবে না। এতে আমাদের আরও কষ্ট বেড়েছে। আধঘণ্টার বেশি দাঁড়িয়ে থেকেও বাস পাচ্ছি না। রাস্তায় বাস অনেক কম। আস্তে আস্তে এ অবস্থার পরিবর্তন করা যেতে পারে। অদক্ষ চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এদিকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে শুরু হওয়া এই বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহের প্রথম তিন দিনে সারা দেশে ৫৮ হাজার ৫৪৯টি মামলা হয়েছে ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, রবি থেকে মঙ্গল এ তিন দিনে দেশের ছয় মহানগর, আট রেঞ্জ ও হাইওয়ে রেঞ্জে এসব মামলা করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৩৮৯ চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জরিমানা হিসেবে আদায় করা হয়েছে এক কোটি ৯১ লাখ ৯০ হাজার ৯৫ টাকা। আর জব্দ করা হয়েছে এক হাজার ৮৭০টি গাড়ি। এমনিতে একদিনে সারা দেশে ট্রাফিক আইনে কতগুলো মামলা হয়, তার কোনো পরিসংখ্যান পুলিশের কাছে নেই। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিশেষ এই ট্রাফিক সপ্তাহে প্রতিদিনের মামলার সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে।
গত ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে বেপরোয়া বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলে ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাজধানী থেকে তাদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ৯ দফা দাবিতে এ আন্দোলনের মধ্যে শিক্ষার্থীরা রাজপথে পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে চালকের লাইসেন্স ও যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা করা শুরু করে। সেখানে দেখা যায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য ও আইন প্রণেতারাও অনেক ক্ষেত্রে আইন মানছেন না। এই প্রেক্ষাপটে ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, ট্রাফিক পুলিশকে সহযোগিতা করুন; ট্রাফিক শৃঙ্খলা একটি জাতির সভ্যতার প্রতীক’ সেøাগান সামনে রেখে গত রোববার শুরু হয় বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ। এক সপ্তাহের এ কর্মসূচির অংশ হিসেবে সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে যানবাহনের নিবন্ধন, লাইসেন্স, ফিটনেস, ইন্স্যুরেন্সের কাগজ দেখে মেয়াদ যাচাই করছেন পুলিশ সদস্যরা। এছাড়া উল্টোপথে গাড়ি চালানো, হাইড্রলিক হর্ন ব্যবহার, হুটার ও বিকন লাইট ব্যবহার, মাইক্রোবাসে কালো গ্লাস ব্যবহার, বিভিন্ন ধরনের স্টিকার ব্যবহারসহ, বাইক চালানোর সময় হেলমেট ব্যবহার না করা, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নেওয়া হচ্ছে ব্যবস্থা।
ট্রাফিক সপ্তাহে ফিটনেসবিহীন গাড়ি না চলায় পরিবহন সংকট
