ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আমরা রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। খ্যামচংপাড়ায় পৌঁছানোর আগে কোনো পানি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই খাবার ও রান্নার পানি আমাদের বহন করতে হবে। সেইসঙ্গে খাবার, ব্যাগ, তাঁবু ও অন্য উপকরণ মিলে বেশ ভারীই বলা যায়। প্রথমে আমরা রংরাং সামিট করব। এরপর যাব খ্যামচংপাড়া। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে নামব ক্রিস্তংয়ের পথে। একদম টাইট শিডিউল। ভোর ৫টার পর আমাদের গাইড লেং মুরংকে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মেনিয়াংপাড়া থেকে। সময় বাঁচাতে আমরা নাস্তা না করে বের হলাম। প্রথম যাত্রাবিরতিতে নাস্তা সারার ইচ্ছা রয়েছে। আজকের নাস্তার মেনু শুকনো খেজুর, চিড়ার মোয়া, ডালভাজা ও খেজুরের গুড়।
ম্যানিয়াংপাড়া থেকে রংরাং কত দূর জানতে চাইতে না চাইতেই ল্যাং মুরংয়ের উত্তরÑদেড় থেকে দুই ঘণ্টার পথ। মনে হচ্ছিল যেন এ প্রশ্নের অপেক্ষাতে ছিলেন লেং।
পাহাড়ি জনপদের ভেতরে বেড়াতে গেলে একটি বিষয় বোঝা যায়, স্থানীয়রা দূরত্ব মাপার জন্য কিলোমিটার বা মাইল ব্যবহার করে না, ব্যবহার করে সময়। সকালের আড়ষ্ট পায়ে শুরু হলো দেড় থেকে দুই ঘণ্টা দূরত্বের ট্রেকিং।
আমাদের পরিকল্পনা ছিল, যাওয়ার পথে কোনো এক জুম ঘরে ব্যাগ রেখে রংরাংয়ে সামিট করব, যাতে কষ্ট কম হয়। নেমে যাওয়ার সময় ব্যাগগুলো নিয়ে চলে যাব সোজা খ্যামচংপাড়ায়। ম্যানিয়াংপাড়া থেকে যাত্রা করে পাহাড়ের ওপর উঠে পেছন ফিরে তাকাতেই অভিভূত হয়ে গেলাম। পাহাড়ের ওপর থেকে ম্যানিয়াংপাড়াকে ছোট্ট সুন্দর একটা কল্পনার গ্রাম বলে মনে হচ্ছিল তখন। এ সৌন্দর্য কল্পনাকেও হার মানায়। এ সৌন্দর্য আপনাকে বারবার টেনে নিয়ে আসবে পাহাড়ের কাছে, আড়ষ্ট পদযুগলকে আরও আড়ষ্ট করে দেবে, অজানা এক আকর্ষণ সামনে এগোতে দেবে না। তবু আমরা ম্যানিয়াংপাড়ার মায়া ত্যাগ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাই, কিন্তু নাস্তা না করে বের হওয়ার কারণে আধা ঘণ্টা যেতে না যেতে পথে একবার যাত্রাবিরতি নিতে হলো। সকালের নাস্তা সেই খেজুর, চকোলেট, চিড়ার মোয়া, গুড় ও পানি। এক ফাঁকে ছবিও তোলা হলো। পাহাড়ের ওপর থেকে দূরের গ্রাম ও পাহাড়গুলো চেনা এবং এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেশ সময় ব্যয় হলো। তাছাড়া সকালের আড়ষ্টতার কারণে আমরা একটু ধীরে-সুস্থে এগোচ্ছিলাম। বিশেষ করে গত কালের মাসল ক্র্যাম্পের ব্যথা আমাকে বেশ ভোগাচ্ছিল, সুযোগ পেলেই ভলিজেল মেখে ম্যাসেজ করে নিচ্ছিলাম।
রাস্তায় কোনো জুমঘর না পেয়ে ঝোপের আড়ালে ব্যাগ ও তাঁবু রেখে রংরাংয়ের শেষ চূড়ায় ওঠা শুরু করলাম। বুঝতে পারলাম, কেন ল্যাংদাদা ব্যাগ রেখে চূড়ায় ওঠার কথা বলেছেন। বেশ কয়েকবার প্রায় ৯০ ডিগ্রি পাহাড় বেয়ে উঠতে হলো, ভারী ব্যাগ নিয়ে যেটা কখনোই সম্ভব হতো না। আমাদের দলের সবাই ট্রেকিংয়ে অভ্যস্ত ও দক্ষ। হাসান ভাই ও উসাই মার্মা তো বেড়েই উঠেছেন পাহাড়ে। বর্তমানে পেশায় গাইড, সপ্তাহে সাত দিনই দাপিয়ে বেড়ান বান্দরবানের নানা চূড়ায়। আর কিরণ ভাই কয়েক বছর ধরে পাহাড়ে যেন ঘর বেঁধেছেন, পেশায় ট্যুর গ্রুপ বিডির গাইড। সেই সূত্রে বেশিরভাগ সময় কাটান পাহাড়ে। আর যে কয় দিন ছুটিতে থাকেন, মেতে থাকেন নতুন কোনো চূড়া অথবা নতুন কোনো ঝরনা জয়ের আনন্দে। সেদিক চিন্তা করলে ট্রেকিংয়ে আমিই সবচেয়ে নবীন।
এরপর কোনো বিশ্রাম না নিয়ে সব বাধাবিপত্তি এড়িয়ে খাড়া পাহাড় বেয়ে আমরা লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম দ্রুত গতিতে। আমি ক্র্যাম্পের ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে দলের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সমান গতিতে। নিজেকে মাশরাফি মনে হচ্ছিল! অবশেষে প্রায় দুই ঘণ্টার ট্রেকিং শেষে সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে আমরা রংরাংয়ে সামিট করলাম।
শাহ জামাল চৌধুরী রেয়ার
রংরাং, আলীকদম, বান্দরবান
২১ মার্চ ২০১৯
মন্তব্য