ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করছেন ৭৭% নারী উদ্যোক্তা

জাকারিয়া পলাশ ও হামিদুর রহমান: দেশের নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে। তবে তাদের অধিকাংশের ব্যবসাই চলছে অনানুষ্ঠানিকভাবে। তাদের মূলধারায় আনতে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। দেশে বিদ্যমান নারী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৯২ শতাংশই পরিচালিত হচ্ছে ঘরে বসে। এদের ৭৭ শতাংশের ট্রেড লাইসেন্সও নেই। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী উদ্যোক্তাদের সামর্থ্য কাজে লাগাতে তাদের লাইসেন্সের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত মার্চে ‘বিজনেস ফাইন্যান্স ফর দ্য পুওর ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা উদ্যোগের ক্লাস্টার ও ভ্যালু চেইন উন্নয়নবিষয়ক অর্থায়ন’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনটিতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও ইউকেএইডসহ বেশ কিছু বিদেশি সংস্থা অর্থায়ন করে।
সূত্রমতে, ওই প্রতিবেদন করার জন্য দেশের ৩০ অঞ্চলের ১০ খাতের ২৮২ উদ্যোক্তার সঙ্গে সংলাপ করেন গবেষকরা। এছাড়া এক হাজার ৭৩৩ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে জরিপ চালানো ছাড়াও ৬২ সরকারি ও বেসরকারি স্টেকহোল্ডারের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, জরিপ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দেখা গেছে, প্রায় ৪৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স নেই। অর্থাৎ তারা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবেই ব্যবসা পরিচালনা করছে। ওই প্রতিবেদনে সার্বিক তথ্যের পাশাপাশি পুরুষ পরিচালিত ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান ও নারী পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, পুরুষ পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট স্থায়ী সম্পদের (ফিক্সড অ্যাসেট) পরিমাণ নারীচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট স্থায়ী সম্পদের দ্বিগুণেরও বেশি। এছাড়া ৯২ শতাংশেরও বেশি নারী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান ঘরে বসে সঞ্চালিত হয় বা তাদের কোনো আলাদা কার্যালয় নেই, যেখানে পুরুষ উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঘরে বসে পরিচালিত হয় ৩৫ শতাংশের মতো।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পুরুষচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২৭ শতাংশের ট্রেড লাইসেন্স নেই। বিপরীত দিকে নারী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলোয় লাইসেন্সবিহীন ব্যবসা করার হার এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ৭৬ দশমিক ছয় শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৭৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানেরই দেখা গেছে ট্রেড লাইসেন্স নেই। এছাড়া প্রায় ৭২ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যবসায়ী সমিতিরও সদস্য নয়।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্রেড লাইসেন্স না থাকলে কিংবা ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য না হলে প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনেক ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন উদ্যোক্তারা। এছাড়া তারা মূলধারার উদ্যোক্তা হিসেবে পরিগণিত হতে পারেন না। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও প্রয়োজন হয় ট্রেড লাইসেন্স, যা ওইসব নারী উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে না। এজন্য নারী উদ্যোক্তাদের সামর্থ্য ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে তাদের লাইসেন্সের আওতায় আনার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আইনসম্মতভাবে অবশ্যই এটি ইতিবাচক নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে হলে লাইসেন্সের বিকল্প নেই। নারী উদ্যোক্তাদের লাইসেন্সের আওতায় আনার জন্য শর্ত শিথিল করা যেতে পারে। কারণ ওইসব উদ্যোক্তা মূলধারায় এলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে; পাশাপাশি কর্মসংস্থানেও ভূমিকা রাখবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক নারী উদ্যোক্তা ব্যবসায় আসছেন, এটি ইতিবাচক। অনেক নারী ব্যবসা শুরুর প্রথম দিকে সাধারণত লাইসেন্সের প্রয়োজন বোধ করেন না। অনেক নারী উদ্যোক্তা বিউটি পার্লার, খামার, কুটিরশিল্পের কারখানা পরিচালনা করেন। প্রায়ই দেখা যায়, লাইসেন্স করতে গেলে তাদের বিভিন্ন ডকুমেন্ট প্রদর্শন করতে হয়, যা তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য। এ কারণে তারা ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করতে চান না। এছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা করার পরিকল্পনা না থাকায় অনেকে ট্রেড লাইসেন্স করেন না। অনানুষ্ঠানিকভাবে (ইনফরমাল ন্যাচার) ব্যবসা করেন। এ কারণে অদক্ষ উদ্যোক্তাদের কারণে দক্ষ উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে মোট ৮০ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা মোট জাতীয় আয়ে (জিডিপি) ২৫ শতাংশ অবদান রাখছে। বৈচিত্র্যময় এসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অর্থায়নের জন্য নীতিগত ব্যবস্থায়ও বৈচিত্র্য প্রয়োজন। কিন্তু দেশে বিদ্যমান অর্থায়ন-সংক্রান্ত প্রোডাক্ট (ব্যাংকের ঋণ স্কিম) নির্ধারণের ক্ষেত্রে ওইসব প্রতিষ্ঠানের বৈচিত্র্যের বিষয়টি আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পণ্যগুলোর সঙ্গে বাজারের চাহিদার অসামঞ্জস্য রয়েছে বলে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, যা এসব প্রতিষ্ঠানের টিকে থাকার জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।
নারী উদ্যোক্তাদের মূলধারায় আসতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়ে বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ সভাপতি সেলিমা আহ্মাদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক নারী উদ্যোক্তা ছোট ছোট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ট্রেড লাইসেন্স করতে অফিসের ঠিকানা দিতে হয়। যে কারণে অনেকেই ট্রেড লাইসেন্স করতে চান না। তবে আমরা তাদের ট্রেড লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করছি। তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। অনেক নারী উদ্যোক্তা অর্থ সংকটে ভোগেন। তাদের সহজ শর্র্তে ঋণ গ্রহণের ব্যবস্থা করছি।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০