নিজস্ব প্রতিবেদক: ছয় বছরে দেশে এক হাজার ১১৬টি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে কমপক্ষে এক হাজার ৩৪৫ জন মারা গেছেন এবং এক হাজার ৩০২ জন আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে। এসব দুর্ঘটনার প্রায় ৮০ শতাংশই ঘটেছে চালক ও স্টেশনমাস্টারদের গাফিলতি, সিগন্যালিং ব্যবস্থার ব্যর্থতা, লাইনচ্যুতি ও লেভেল ক্রসিংয়ের ত্রুটিতে। তবে ট্রেন দুর্ঘটনায় দায়ী কারোর কখনোই শাস্তি বা বিচার হয় না।
গত সোমবার বিকালে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে একটি কনটেইনারবাহী ট্রেনের সঙ্গে এগারসিন্দুরের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান ১৭ যাত্রী, আহত হন শতাধিক। পরে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে একাধিক তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। যদিও প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছে, কনটেইনারবাহী ট্রেন সিগন্যাল অমান্য করায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে কারিগরি ত্রুটিও থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে ৪০২টি রেল দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৩৯৬ জন নিহত হয়েছেন। আর ২০২২ সালে ৬০৬টি রেল দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন নিহত হয়েছেন। তবে এই সংখ্যার মধ্যে রেলক্রসিংয়ের দুর্ঘটনাও রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামছুল হক কয়েকটি ট্রেন দুর্ঘটনার তদন্তের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন সম্প্রতি শেয়ার বিজের কাছে। এর মধ্যে একটির উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি জানান, কমলাপুর আইসিডির ভেতর একবার ট্রেনের সঙ্গে ট্রাকের সংঘর্ষের তদন্ত করতে গিয়েছিল বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধি দল। তবে তাদের সঙ্গে ট্রেন চালকের সাক্ষাৎ করতে দেয়া হচ্ছিল না। যদিও ট্রেন চালকের জবানবন্দি ছাড়া তদন্তে কোনোভাবেই উপসংহার টানা যাচ্ছিল না।
অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল ট্রেনকে ট্রাক ধাক্কা দিয়েছিল। তবে দুর্ঘটনার ধরন এবং ট্রাক ও দুর্ঘটনাকবলিত দুটি বগি বলছিল ট্রেনটি ট্রাককে ধাক্কা দেয়। বহু চেষ্টার পর ট্রেন চালকের জবানবন্দি পাওয়া যায়। তিনি সে সময় স্বীকার করেন ট্রাকটি দাঁড়ানো ছিল এবং ট্রেন গিয়ে সেটাকে ধাক্কা দেয়। তবে ট্রেনের ইঞ্জিনের গতি এত বেশি ছিল যে, ট্রাকটি ঘুরে পেছন দিয়ে ট্রেনের দুটি বগিতে আঘাত করে। যদিও সে ঘটনায় ট্রেন চালককে সাময়িক বরখাস্তই করা হয়েছিল। এর বেশিকিছু হয়নি।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অপর অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, রেলের যে কোনো দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন হলেও, কমিটির কোনো রিপোর্টই ঠিকঠাক বাস্তবায়ন হয় না। শুধু তদন্ত কমিটি গঠন ও সাময়িক বরখাস্তেই শেষ হয় কার্যক্রম। লোকবল স্বল্পতার অজুহাতে বরখাস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিছু দিন পরই পুনর্বহাল করতে হয়।
এ বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালকের বক্তব্য জানতে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলের একাধিক অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, রেলওয়েতে লোকবল সংকট ব্যাপক। তাই অনেক সময় বাধ্য হয়েই দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের কোনো শাস্তির আওতায় আনা যায় না। কিছুদিন সাময়িক বরখাস্ত রেখে পুনরায় চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়।
প্রসঙ্গত, নানা সময়ে ঘটেছে বিভিন্ন প্রাণঘাতী ট্রেন দুর্ঘটনা। দেশের ইতিহাসের আলোচিত কয়েকটি ট্রেন দুর্ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো। এসব দুর্ঘটনার কোনোটিতেই দায়ীদের কোনো বিচার বা শাস্তির ব্যবস্থা হয়নি।
সবচেয়ে বড় ট্রেন দুর্ঘটনা টঙ্গীতে: দেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮৯ সালের ১৫ জানুয়ারি টঙ্গীতে। ওই দুর্ঘটনায় ১৭০ জন নিহত হন। আহত হন আরও ৪০০ যাত্রী।
ঈশ্বরদীতে সেতু ভেঙে দুর্ঘটনা: ১৯৮৩ সালের ২২ মার্চ ঈশ্বরদীর কাছে ট্রেন রেল সেতু পার হওয়ার সময় কয়েকটি স্প্যান ভেঙে পড়ে। এতে নিচে শুকনো জায়গায় গিয়ে পড়ে ট্রেনের কয়েকটি বগি। ওই ঘটনায় ৬০ জন যাত্রী নিহত হন।
খুলনায় আগুন ধরে দুর্ঘটনা: ১৯৮৫ সালের ১৩ জানুয়ারি খুলনা থেকে পার্বতীপুরগামী সীমান্ত এক্সপ্রেসের কোচে আগুন ধরে যায়। এতে ২৭ জন যাত্রী নিহত হন এবং ২৭ জন আহত হন।
সর্বহারা পার্টির নাশকতা: ১৯৮৬ সালের ১৫ মার্চ সর্বহারা পার্টির নাশকতায় ভেড়ামারার কাছে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে নদীতে পড়ে যায়। এতে ২৫ জন যাত্রী নিহত হন এবং ৪৫ জন আহত হন।
হিলি ট্র্যাজেডি: ১৯৯৫ সালের ১৩ জানুয়ারি রাত সোয়া ৯টায় গোয়ালন্দ থেকে পার্বতীপুরগামী ৫১১ নম্বর লোকাল ট্রেনটি হিলি রেলস্টেশনের ১ নম্বর লাইনে এসে দাঁড়ায়। এর কিছুক্ষণ পর সৈয়দপুর থেকে খুলনাগামী ৭৪৮ নম্বর আন্তঃনগর সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি একই লাইনে ঢুকে পড়ে। এ সময় মুখোমুখি সংঘর্ষে গোয়ালন্দ লোকাল ট্রেনের ইঞ্জিনসহ দুটি বগি আন্তঃনগর ট্রেনের ওপর উঠে যায়। এতে দুটি ট্রেনের অর্ধশতাধিক যাত্রী নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক।
নরসিংদীর দুর্ঘটনা: ২০১০ সালে চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর ‘মহানগর গোধূলি’ ও ঢাকাগামী মেইল ‘চট্টলা’ ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনায় দুটি ট্রেনের ইঞ্জিন দুমড়েমুচড়ে যায়। চট্টলা ট্রেনের একটি বগি মহানগর ট্রেনের ইঞ্জিনের ওপর উঠে যায়। সেই দুর্ঘটনায় চালকসহ মোট ১২ জন নিহত হন।