মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: এক সময় বাংলা একডেমি প্রাঙ্গণে একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হতো। দেখা যেত লেখক, পাঠক, দর্শনার্থীর ভিড়। মেলার সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভিড় আরও বাড়ত। এক সময় তা জনসমুদ্রে পরিণত হতো। একাডেমি প্রাঙ্গণে তিল ধারণের ঠাঁই থাকত না।
দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে বইমেলার আকৃতিও বদলে গেছে। বেড়েছে প্রকাশক, বেড়েছে লেখক ও ক্রেতা-দর্শনার্থী। কিন্তু বইমেলার আকার বাড়লেও সে হারে বাড়েনি পাঠক। প্রকাশিত বইয়ের পাশাপাশি প্রকাশক ও প্রকাশনা সংস্থা বাড়লেও ঠকছেন তরুণ লেখকরা। অভিযোগ রয়েছে, বই প্রকাশ থেকে শুরু করে রয়্যালটি (সম্মানী) পাওয়া পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই ঠকছেন তারা। আবার মানসম্মত লেখক খুব কম বলে অভিমত প্রকাশ করেন প্রকাশকরা। যে কারণে তারা এসব লেখকের বই প্রকাশে অনীহা প্রকাশ করেন।
২০১৪ সালে গতানুগতিক বৃত্ত ভেঙে সম্প্রসারিত করা হয় একুশে বইমেলা। বাংলা একাডেমির পাশাপাশি মেলা বিস্তৃত হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এরপর থেকে প্রতিবছরই ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে মেলার পরিসর। বাড়ছে নতুন বই প্রকাশের সংখ্যা ও বই-বাণিজ্য।
গত ছয় বছরে গ্রন্থমেলায় বই বিক্রি বেড়েছে প্রায় সাড়ে চারগুণ। এবারের মেলা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিতে চলেছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এবারের মেলায় অংশ নিয়েছে ৫৬০ প্রকাশনা সংস্থা। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৫৫০। বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০০২ সালে মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা ছিল ২৪০। ২০০৩ সালে ২৬৭, ২০০৪ সালে ৩১২, ২০০৫ সালে ৩১৮, ২০০৬ সালে ৩১৭, ২০০৭ সালে ২৫৫, ২০০৮ সালে ২৩৬, ২০০৯ সালে ৩২৬, ২০১০ সালে ৩৫৬, ২০১১ সালে ৩৭৬, ২০১২ সালে ৪২৫, ২০১৩ সালে ২৭৪, ২০১৪ সালে ২৯৯, ২০১৫ সালে ৩৫১, ২০১৬ সালে ৪০২, ২০১৭ সালে ৪০৯ ও ২০১৮ সালে ৪৫৫টি।
এদিকে প্রকাশনা সংস্থা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রতিবছরই বাড়ছে মেলায় নতুন বইয়ের প্রকাশনাও। ২০১৪ সালে মেলায় প্রকাশিত নতুন বইয়ের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৯৫৯, ২০১৫ সালে তিন হাজার ৭০০, ২০১৬ সালে তিন হাজার ৪৪৪, ২০১৭ সালে তিন হাজার ৬৪৬ ও ২০১৮ সালে চার হাজার ৫৯১টি। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় চার হাজার ৮৩৪টিতে।
চলতি বছর (গতকাল পর্যন্ত) মোট বই এসেছে দুই হাজার ৭৮৩টি। মেলা কর্তৃপক্ষের দাবি, শেষ পর্যন্ত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এ হিসাব অনুযায়ী, গত ছয় বছরে মেলায় নতুন বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে দেড়গুণেরও বেশি। তবে এ হিসাব শুধু মেলার তথ্যকেন্দ্রে জমা পড়া বইভিত্তিক। প্রকাশিত বইয়ের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি বলে জানা গেছে।
প্রকাশের পাশাপাশি বই বিক্রির হারও বেড়েছে এ সময়। বাংলা একাডেমির হিসাবমতে, ২০১৪ সালে ১৬ কোটি টাকার, ২০১৫ সালে ২১ কোটি ৯৫ লাখ, ২০১৬ সালে ৪২ কোটি, ২০১৭ সালে ৬৫ কোটি ও ২০১৮ সালের মেলায় ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়। সর্বশেষ বছর তা বেড়ে হয় প্রায় ৭৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ বছর তা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. জালাল আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, মেলায় মোট কত টাকার বই বিক্রি হয়েছে, তা মেলা শেষে জানিয়ে দেওয়া হবে। আমাদের কাছে এখনও এ তথ্য নেই। তবে মনে করছি গতবারের চেয়ে এবার বিক্রির পরিমাণ আরও বাড়বে।
বাংলা একাডেমির অন্য একটি সূত্র জানায়, প্রথম ২০ দিনে (গতকাল বিকাল পর্যন্ত) শুধু বাংলা একাডেমির নিজস্ব বই বিক্রি হয়েছে এক কোটি ৩৫ লাখ টাকার। আর সব মিলে মোট বিক্রি ৪০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তিনি জানান, শেষদিকে কেনাবেচা বেশি হয়। ফলে বাকি দিনগুলোয় যে বিক্রি হবে, তা ৪০ কোটি টাকার দ্বিগুণের বেশি হয়ে যাবে।
এ বছরের মেলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এবারের আয়োজনটি আরও ভালো করতে। তাতে আমরা সফল হয়েছি। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত যে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, তাতে মনে হয় রেকর্ড পরিমাণ বই বিক্রি হবে।

এদিকে অভিযোগ রয়েছে, নবীন-প্রবীণ লেখকদের বই প্রকাশের সংখ্যা বাড়লেও সম্মানী পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতারিত হচ্ছেন তারা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঠকছেন তরুণ লেখকরা। বই প্রকাশ থেকে শুরু করে সম্মানী পাওয়া পর্যন্ত পদে পদে ঠকতে হয় তাদের। সুযোগের অভাবে বেশিরভাগ নতুন লেখককে নিজের অর্থে বই প্রকাশ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে শুধু আইএসবিএন (ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড বুক নাম্বার) ব্যবহারের জন্য প্রকাশকের দ্বারস্থ হন। লেখকদের অভিযোগ, বেশিরভাগ প্রকাশকের যে পরিমাণ বই প্রকাশ করার কথা, তা করেন না। অনেকে লেখকের কাছ থেকে নিয়ে সময়মতো বই প্রকাশ করতে ব্যর্থ হন। কেউ কেউ আবার মেলার শেষদিকে মানহীন বই প্রকাশ করে লেখকের কাছে হস্তান্তর করেন। ফলে তা পাঠকের কাছে পৌঁছায় না। এতে লেখক যে উদ্দেশ্যে বই প্রকাশ করেছেন, সে উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। আবার তরুণ লেখকের বই ভালো বিক্রি হলেও যে পরিমাণ বিক্রি হয়েছে, ব্যবসা মন্দার দোহাই দিয়ে সেই রয়েলটিও পরিশোধ করা হয় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি প্রকাশনা সংস্থার স্বত্বাধিকারী শেয়ার বিজকে বলেন, তরুণ লেখকরা বেশি ঠকেন ছোটদের বই থেকে। শিশু-কিশোররা বইয়ের প্রচ্ছদ ও নাম দেখেই বই কিনতে পছন্দ করে। এ ক্ষেত্রে কে লেখক তা বিবেচনায় থাকে না। তাই অনেক তরুণ লেখকের বই সন্তোষজনক হারে বিক্রি হয়। কিন্তু রয়েলটি দেওয়ার সময় তাদের কাছে কত কপি বই বিক্রি করা হয়েছে, তা গোপন করা হয়। শুধু নতুন লেখকরাই নন, অনেক প্রবীণ লেখকও এ ধরনের প্রতারণার শিকার হন।

অন্যদিকে বই বিক্রি বাড়লেও সে হারে পাঠক তৈরি হচ্ছে না। গুণীজনরা মনে করেন, পাঠক কমে যাওয়ার প্রধান কারণ ফেসবুক, ইন্টারনেট ও আকাশ সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দেওয়া। এক সময় বিনোদনের মাধ্যম ছিল বই পড়া। একটাই চ্যানেল ছিল ‘বিটিভি’। প্রতি পরিবারের ছেলেমেয়েরা কখন টিভি দেখবে, কখন বই পড়তে সবকিছুর রুটিন ছিল। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। রিমোট চাপলেই ডজন ডজন চ্যানেল। গুগলে ঢুকলেই পৃথিবীর যে কোনো বিষয়ে জানা সম্ভব। এখন ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে মোবাইল ফোন। তারা ভিনদেশি ভিডিও দেখে, গেম খেলে সময় পার করছে। ফলে বই পড়ার সময় যাচ্ছে না। এতে পাঠক কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বেশিরভাগ অভিভাবক বই কিনে সেলফ-বন্দি করে রাখেন। নিজেরা পড়েন না; আবার অন্যদেরও পড়তে বলেন না। ফলে পাঠক তৈরি হয় না।
বড়দের মতো ছোটরাও এখন ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে সহজেই ঢুকে পড়ছে নেট দুনিয়ায়। মেতে থাকছে এটি নিয়ে। তারা কী দেখছে, কী শিখছে, তার খোঁজ রাখছেন না বেশিরভাগ মা-বাবা। কারণ আরও রয়েছে। ছেলেমেয়েরা এখন খুব বেশি ব্যস্ত থাকছে। স্কুল, কয়েকজন শিক্ষক, গানের ক্লাস, নাচ আর ছবি আঁকার ক্লাস… আরও কত কী! সবাই ছেলেমেয়েকে ফাস্ট বানাতে চান। একসঙ্গে সবকিছু করাতে চান। অলরাউন্ডার বানাতে চান। সবাই সন্তানকে ডাক্তার, প্রকৌশলী, পুলিশ অফিসার কিংবা বড় কর্তা হতে বলেন। কিন্তু কেউ বলেন না ভালো মানুষ হতে, পড়ুয়া হতে। ডাক্তার, প্রকৌশলী, পুলিশ অফিসার বানানোর নেশায় মা-বাবারা একজনের স্থলে পাঁচজন প্রাইভেট শিক্ষক দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না। ফলে দম ফেলার সময় পায় না সন্তানরা। এটাও পাঠক তৈরির অন্তরায়।

এ প্রসঙ্গে কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন শেয়ার বিজকে বলেন, পাঠক তৈরি না হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে মানসিকতা। আমাদের দেশের সিংহভাগ অভিভাবকই মনে করেন, জ্ঞান সম্পদ নয়। যে কারণে তারা টাকা নিয়ে সম্পদ কেনেন কিন্তু বই কেনেন না। আবার যারা বই কেনেন, তারা শুধু লোক দেখানোর জন্যই বই কিনে নিয়ে সাজিয়ে রাখেন। বেশিরভাগ ক্রেতাই বই পড়েন না। এমনকি তারা তরুণ-তরুণীদের বোঝান না পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়া দরকার। যে কারণে পাঠক তৈরি হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সবার আগে পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে।