Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 3:46 pm

ঠাকুরগাঁওয়ে গাছে গাছে উঁকি দিচ্ছে আমের মুকুল

শামসুল আলম, ঠাকুরগাঁও: বসন্ত এসেছে ধরায়। চারদিকে হু হু করে বইছে বসন্তের ফালগুনি হাওয়া। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে আমের মুকুলের স্বর্ণালি শোভা। অপরূপ সৌন্দর্য ও ঘ্রাণে ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে এখন আমগাছে চোখ মেলে যেন উঁকি দিচ্ছে কচি আমের মুকুল। জেলার প্রতিটি উপজেলায় ও প্রতিটি বসতবাড়িসহ বাগানে বাগানে এখন মৌসুমি ফল আমের মুকুলে ছেয়ে গেছে। এ জেলায় বড় ধরনের কোনো শিলাবৃষ্টি বা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে আমের ভালো ফলন আশা করছেন আমচাষিরা।

ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, ঠাকুরগাঁও জেলার ৫টি উপজেলায় এবার মোট আমবাগানের জন্য জমি রয়েছে দশ হাজার ৪০ হেক্টর। গত তিন বছরে আমবাগান বেড়েছে ১৬০টি। ১০ বছরে বেড়েছে দ্বিগুণ। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সদর উপজেলার বসতবাড়িসহ অনেকের বিভিন্ন জাতের বাগান রয়েছে। এসব বাগানের প্রতিটি আমগাছে এবার প্রচুর আমের মুকুল এসেছে। তবে ঝড়ো হাওয়া, পর্যাপ্ত পরিচর্যা ও পোকার আক্রমণে আমের মুকুল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ভেলাজান নয়াপাড়া গ্রামের আমবাগান মালিক মো. রুস্তম আলী মাস্টার জানান, শুধু ধান ও গম করে তেমন লাভ নেই। প্রায় দুই একরের বেশি জমিতে বারি-৪ জাতের আমগাছের বাগান করেছি। এ বাগানে কম বেশি ছয়শ’র বেশি আমগাছ রয়েছে। এ বারি-৪ জাতের আমগাছ একটানা ২০ থেকে ৩০ বছর ফল দিয়ে থাকে। এ বাগান করতে আমার খরচ হয়েছে প্রায় চার-থেকে পাঁচ লাখ টাকার মতো। এই জাতের আমগাছ থেকে গাছ লাগানোর পর দুই বছরের মধ্যে আম ধরে। গত কয়েক বছর আমার বাগানে আম ধরছে। গত বারের চেয়ে এবার বাগানে বেশি মুকুল এসেছে। এ জাতের আম দুই-তিনটা আমের ওজন এক কেজি হয়। আম পাকে আশ্বিন মাসের শেষ দিকে। তখন এই আম প্রতিকেজিতে বিক্রি হয় ২০০-২৫০ টাকা। বিগত বছরে বাগানে আলু ও শাক, হলুদ, আদা সবজি আবাদ করছি। গত বছর সময়মতো কীটনাশক ছিটিয়ে ও পরিচর্যা করে ভালো ফলন ও দাম পেয়েছি। এবারও তাই করব।

ঠাকুরগাঁও পীরগঞ্জ উপজেলার ভাবনাঞ্জ এলাকার আমবাগান মালিক মো.  ফরহাদ হোসেন জানান, আমার বাগানে ৩০০টির বেশি আমগাছ রয়েছে। আমার বাগানের বেশির আম গাছ সূর্যপুরি ও আম্রপালি। আমগাছে প্রচুর মুকুল এসেছে। ধান ও অন্যান্য ফসল থেকে আম ও লিচুর বাগান করে লাভ বেশি। এতে পরিশ্রমও কম হয়। বাগানে আম একটু বড় হলে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিই। গত বছর আমি এ বাগান থেকে পাঁচ লাখ টাকার মতো লাভ করছি। তাছাড়া সূর্যপুরি ও আম্রপালি আম ও লিচু একটি জনপ্রিয় ও রসালো ফল। দেশে-বিদেশে আমের খুবই চাহিদা রয়েছে। এতে আমার টেনশন কম থাকে। তাছাড়া আমবাগানের পাশাপাশি সাথী ফসল হিসেবে শাকসবজিও আবাদ করা যায়। ঠাকুরগাঁওয়ে বিভিন্ন জাতের আম যেমন বারি ৪, আম্রপালি, সূর্যপুরী, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, আসিনিয়া, মোহনা, ফজলি, মিশ্রিভোগসহ দেশি জাতের বিভিন্ন জাতের আমের মুকুলে ভরপুর বাগানগুলো। প্রতি মৌসুমে জেলায় আম বিক্রি করে লাভবান হয় অনেক চাষি ও আম ব্যবসায়ীরা।

ঠাকুরগাঁও পীরগঞ্জ উপজেলার চাষি সাইফুর রহমান বাদশা জানান, শুধু ধান ও পাট আবাদ করে তেমন লাভ পাই না । তাই  আম বাগান করছি। বাগানে কম বেশি তিনশর বেশি গাছ রয়েছে। অধিকাংশ গাছ  আম্র্রপালি, সূর্যপুরী, ল্যাংড়া জাতের। আমগাছে এবার ভালো মুকুল এসেছে। গত বছর সময়মতো কীটনাশক ছিটিয়ে ও পরিচর্যা করে অনেক টাকা আয় করা সম্ভব হয়েছে। তিনি জানান, প্রতি বছরই তার বাগান থেকে সারাদেশে আম সরবরাহ করেন। তার মতো অনেক বেকার যুবক এখন বাণিজ্যিকভাবে আম্রপালি আমের বাগানের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এসব বাগানে গাছ লাগানোর ২-৩ বছরের মধ্যেই আম পাওয়া যায়। লাগাতার ফল দেয় ১০-১২ বছর। ফলনও হয় ব্যাপক।

ঠাকুরগাঁওয়ের অনেক বাগান মালিক জানান, বিগত বছরের চেয়ে এবার আমের মুকুল ভালো এসেছে। আবহাওয়া ভালো থাকলে আমের সর্বোচ্চ  ফলন হবে বলে তারা আশা করে।

আমের ভালো ফলন এবং রং ভালো রাখার জন্য বাগানে গাছের গোড়ায় পানি দিচ্ছেন। মুকুল থেকে গুটি বের হলে নিয়মমাফিক ভিটমিন ও কীটনাশক স্প্রে করা হবে।

ঠাকুরগাঁওয়ে অনেক ব্যবসায়ী দুই-তিন বছরের চুক্তিতে আমবাগান ক্রয় করেন। তারাই তখন বাগান দেখভাল ও পরিচর্যা করে। এতে মালিকের কোনো লোকসানের টেনশন থাকে না। তাছাড়া আমাদের ঠাকুরগাঁও জেলা আম চাষের জন্য বিখ্যাত। প্রতি বছর স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এ জেলা থেকে আম দেশ-বিদেশে বিক্রি হয় ৪০-৫০ কোটি টাকার মতো।

ঠাকুরগাঁওয়ে সূর্যপুরি, শুধু আম্রপালি ছাড়াও এ এলাকায় হাঁড়িভাঙা, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ফজলি ও হিমসাগর আমের আবাদ হচ্ছে। বাগানগুলোতে আমগাছের পাশাপাশি সাথী ফসল হিসেবে গমসহ অন্যান্য ফসলেরও আবাদ করছেন চাষিরা। ইতোমধ্যে বাগানগুলোতে ব্যাপক মুকুল এসেছে। অনেকে বাগান করে আগাম বিক্রি করে দিচ্ছেন ফল ব্যবসায়ীদের কাছে। বড় বড় অনেক আমবাগান দুই-তিন বছর কিংবা তার অধিক সময়ের জন্য অগ্রিম বিক্রি হয়ে যায়। কিছু বাগান বিক্রি হয় মুকুল দেখে। আবার কিছু বাগান বিক্রি হয় ফল মাঝারি আকারের হলে। বাগানের পাশ দিয়ে হাঁটলেই মুকুলের ঘ্রাণে মন প্রাণ ভরে ওঠে।

বাগান ব্যবসায়ী তোতা মিয়া আলী জানান, গত বছরের মতো এ বছরও আবহাওয়া ভালো থাকায় ব্যাপক মুকুল দেখা যাচ্ছে। ব্যবসায়ী ও বাগান মালিকরা বলছেন, মুকুল দেখে আশা করা যায় এবার আমের ব্যাপক ফলন হবে। শিলাবৃষ্টি বা ঝড় না হলে ব্যাপক আমের ফলন পাওয়া যাবে বলে জানান তারা, যা ২০০ কোটি টাকার বেশি আমবাণিজ্য হবে।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. মামুন হোসেন  জানান, ছত্রাকে যাতে মুকুল নষ্ট না হয় সেজন্য কীটনাশক হিসেবে ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের দানাদার প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম ও সাইপারম্যাক্সিন গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে এক মিলিলিটার মিশিয়ে স্প্রে করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। মুকুল গুটিতে পরিণত হওয়ার সময় একই মাত্রায় দ্বিতীয়বার স্প্রে করতে হবে।

ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আব্দুল আজিজ জানান, ঠাকুরগাঁও জেলার সূর্যপূরী আম সারাদেশে সুনাম  কুড়িয়েছে। এখানকার আমে পোকা থাকে না। এটা এখানকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আমের আকার দেখতে ছোট হলেও স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। আবহাওয়া ভালো থাকলে এবং কালবৈশাখী বা ঝড় না হলে ব্যাপক ফলন আশা করা যাচ্ছে।