রহমত রহমান ও হামিদুর রহমান : চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদার নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করেনি। শর্তানুযায়ী ঠিকাদার নিয়োগ দেয়নি বিদেশি দক্ষ প্রকৌশলী। আবার কাজের সময় বাড়ানোর আবেদনও করেনি ঠিকাদার। অথচ ঠিকাদারের হয়ে পাঁচ বছর সময় বৃদ্ধির আবেদন করেছে ঠিকাদার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। কী কারণে সময় বাড়ানো প্রয়োজন, তা আবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলে ঠিকাদারকে জরিমানার শর্ত দেয়া হয়েছে। শর্তানুযায়ী ঠিকাদার থেকে জরিমানার ১৩২ কোটি টাকা আদায় করার কথা। কিন্তু অজানা কারণে সেই টাকা আদায় করেনি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) নিরীক্ষায় এই বেবিচকের ভয়াবহ অনিয়ম উঠে এসেছে। এছাড়া অতিরিক্ত দরে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ক্রয়, নন-শিডিউল ফ্লাইট বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশের অসম চুক্তিসহ বেবিচকের প্রায় ২৮৩ কোটি টাকা অনিয়ম নিরীক্ষায় উঠে এসেছে।
নিরীক্ষায় দেখা গেছে, বেবিচক ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর, কক্সবাজার বিমানবন্দর, সিলেট ওসমানি বিমানবন্দর, বেবিচক প্রধান কার্যালয় ও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের জন্য বিভিন্ন ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের কার্গো অ্যাপ্রোন নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ট্রেডার্সের সঙ্গে চুক্তি করে। কাজের চুক্তিমূল্য ৭৫ কোটি ৭২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৬৯ টাকা। কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। কিন্তু কাজ শেষ হয়েছে ২০১৯ সালের ২০ জুন। অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের ২৭২ পর কাজ শেষ হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদার বিলম্বে কাজ শেষ হওয়ায় লিকুইডেটেড ড্যামেজ (এলডি) বা জরিমানা ৭ কোটি ৫৭ লাখ ২৪ হাজার ৪৬৬ টাকা আদায় করার কথা। কিন্তু তা আদায় করা হয়নি, যেজন্য সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
একইভাবে কক্সবাজার বিমানবন্দরের উন্নয়নে ৫৭৮ কোটি ২৫ লাখ ৯২ হাজার ৫২০ টাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমএএইচ শিকওয়াংকের (জেভি) সঙ্গে চুক্তি হয়। কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু তারও দুই বছর পর ২০২১ সালে কাজ শেষ হয়েছে। এতে ঠিকাদারকে ৫৭ কোটি ৮২ লাখ ৫৯ হাজার ২৫২ টাকা জরিমানা করার কথা থাকলেও জরিমানা করা হয়নি। সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ে সম্প্রসারণে ৩৮৯ কোটি ৭৪ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৮ টাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তারের সঙ্গে চুক্তি হয়। ২০২০ সালের ১০ জুন কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু কাজ শেষ হয় সাত মাস পর, অর্থাৎ ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। এতে ৩৮ কোটি ৯৭ লাখ ৪৬ হাজার ১৭৮ টাকা জরিমানা করার কথা থাকলেও করা হয়নি। এই তিন বিমানবন্দরের উন্নয়ন কাজে তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চুক্তির শর্তানুযায়ী মোট ১০৪ কোটি ৩৭ লাখ ২৯ হাজার ৮৯৬ টাকা জরিমানার কথা থাকলেও করা হয়নি।
অপরদিকে, বেবিচকের প্রধান কার্যালয়, কুর্মিটোলার কোয়ার্টার কমপ্লেক্স নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কোং লিমিটেডের সঙ্গে ১২৪ কোটি ১৬ লাখ ৮৯ হাজার ৮৭০ টাকায় চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বরের কথা থাকলেও কাজ শেষ হয় ২০২০ সালের ২৭ ডিসেম্বর। অর্থাৎ বিলম্বিত সময় পাঁচ বছর এক মাস ১২ দিন। এ সময়ে ১২ কোটি ৪১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৮৭ টাকা জরিমানা আরোপের কথা, কিন্তু জরিমানা করা হয়নি। হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরের এক্সপোর্ট কার্গো অ্যাপ্রোনের সম্প্রসারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সঙ্গে ১৫৫ কোটি ২৬ লাখ ৮০ হাজার ৯০০ টাকায় চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ১০ মাস ১২ দিন অতিরিক্ত সময়ে কাজ শেষ হয়েছে। এ সময়ে ১৫ কোটি ৫২ লাখ ৬৮ হাজার ৯০ টাকা জরিমানা আরোপের কথা। কিন্তু জরিমানা আরোপ করা হয়নি। এই দুটি কাজে মোট ২৭ কোটি ৯৪ লাখ ৩৭ হাজার ৭৭ টাকা জরিমানার কথা, যা করেনি বেবিচক। এই টাকা সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
নিরীক্ষায় আরও দেখা গেছে, ঠিকাদার চুক্তি অনুযায়ী কাজে দক্ষ বিদেশি প্রকৌশলী নিয়োগ দেয়নি। এছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে না পারলেও নিজেরা মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করেনি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে বেবিচক সময় বৃদ্ধির আবেদন করে সময় বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু কেন সময় বৃদ্ধি করা হলো তার কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। পাঁচটি কাজ বিলম্বে শেষ হওয়ায় ১৩২ কোটি ৩১ লাখ ৬৬ হাজার ৯৭৩ টাকা জরিমানা করার কথা। কিন্তু কোনো জরিমানা করা হয়নি, যা সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ঠিকাদার দক্ষ বিদেশি প্রকৌশলী নিয়োগ না করার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং জরিমানার অর্থ আদায়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।
অপরদিকে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বিমানবন্দরে অ্যাপ্রোন সম্প্রসারণ কাজের টেন্ডার, বিল ও এস্টিমেটের তথ্য দেখা যায়, ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রাক্কলিত দরের অতিরিক্ত দরে সরাসরি কেনায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় তিন কোটি ৭২ লাখ টাকা। একই সময়ে নন-শিডিউল ফ্লাইট বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশের পারমিট পাসেসিং মডিউল ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইসিটি) কাজের নেটওয়ার্কিং অটমোশনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না করে প্রাপ্য ফি-এর ৮৫ শতাংশ কমিশন ঠিকাদারকে প্রদানের অসম চুক্তি করে কমিশন প্রদানের ফলে প্রায় ১৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিগুলো করা হয় এএসএল সিস্টেমসের সঙ্গে। চুক্তি মোতাবেক নন-শিডিউল ফ্লাইট বাংলাদেশের আকাশসীমায় প্রবেশের পারমিট প্রসেসিংয়ে প্রতিটি ফ্লাইটের জন্য ১৯৫ ডলার ফি আদায় করা হবে, যার ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ ১৬৫ দশমিক ৭৫ ইউএস ডলার কমিশন হিসেবে পাবে ঠিকাদার এবং বাকি ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ২৯ ডলার সিএএবি’র তহবিলে জমা হবে, যা সব ক্ষেত্রেই কমিশনের পরিমাণ কম হয় এবং প্রাপকের অংশ বেশি হয়, যা একটি অসম চুক্তি। এই অসম চুক্তি করায় (জিএফআর)-২১ (৫) লঙ্ঘিত হয়েছে।
সূত্রমতে, একই সময়ে অর্থাৎ ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিমানবন্দরে অ্যাপ্রোন মার্কিং কাজে প্রকৃত এরিয়ার চেয়ে বেশি এরিয়া মেজারমেন্ট বুক (এমবি) ও বিলে অন্তর্ভুক্ত করে বিল প্রদান করায় ঠিকাদারকে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করা হয়েছে এক কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা অ্যাপ্রোন মার্কিং কাজে প্রকৃত এরিয়া অপেক্ষা বেশি এরিয়া এমবি ও বিলে অন্তর্ভুক্ত করে বিল প্রদান করায় চুক্তির পিসিসি ক্লজ-১৯ লঙ্ঘন করা হয়েছে। এছাড়া বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোন নির্মাণেও বালি ভরাট মেকানিক্যাল কমপ্যাকশন না করা হলেও মেকানিক্যাল কমপ্যাকশন বিল ঠিকাদারকে প্রাপ্যতা ব্যতীত প্রদান করায় প্রায় চার কোটি ২০ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। কাজটি করেন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ট্রেডার্স। প্রকল্পটিতে বালি ভরাট কাজের মেকানিক্যাল কমপ্যাকশন না করা হলেও মেকানিক্যাল কমপ্যাকশন বিল প্রদান করায় জিএফআর-২৫ লঙ্ঘন করা হয়।
কয়েকটি প্রকল্পেই জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে। একের পর এক অনিয়ম হলেও যথাযথ আইননানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এ ধরনের অনিয়ম হচ্ছে বলে জানায় খাতসংশ্লিষ্টরা।
এই বিষয়ে অতিরিক্ত সচিব ও সিভিল এভিয়েশনের সদস্য (ফিন্যান্স) মো. আজিজ তাহের খান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এগুলো আমাদের রেগুলার রুটিন। আমরা বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছি। আমাদের খণ্ড খণ্ড মিটিংও হয়েছে, বিষয়গুলো মনিটরিং হচ্ছে। সামনে আবারও বিষয়গুলো নিয়ে মিটিং করব। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।’