দীপংকর বর: বাংলাদেশের নদনদীতে হঠাৎ করে এক ধরনের বড় সাইজের জলজ প্রাণীকে ভেসে উঠে আবার ডুবে যেতে দেখা যায়। অনেকে মাছ বলে ভুল করলেও এটি আসলে এক ধরনের সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। এটি বিশ্বব্যাপী ডলফিন নামে পরিচিত হলেও বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক এটিকে শুশুক নামে জানে। সুন্দরবন এলাকায় এটিকে শিশু, ঠুস, সিরাজগঞ্জে শিশুক, সিলেটে শিশু, রাজশাহীতে শুশু, চট্টগ্রামে হোচ্চুম ইত্যাদিসহ বিভিন্ন নামে এটি পরিচিত। বিশ্বব্যাপী ৪০টি প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে সাত প্রজাতির ডলফিন দেখা গেলেও গাঙ্গেয় ডলফিন ও ইরাবতী ডলফিনই বেশি দেখা যায়। ডলফিন দৈর্ঘ্যে সাধারণত চার ফুট থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত এবং ওজনে ৪০ কেজি থেকে ১০ টন পর্যন্ত হতে পারে। ডলফিন পর্যায়ক্রমে মস্তিষ্কের এক অংশ বন্ধ করে বিশ্রাম দেয় এবং পরে আরেকটি অংশকে বিশ্রাম দেয়। তাই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এরা ঘুমায় কখন? এদের মাছের মতো ফুলকা নেই, তাই অক্সিজেন গ্রহণের জন্য মাঝে মাঝে পানির ওপরে ভেসে ওঠে। অক্সিজেন নিয়ে আবার তলিয়ে যায়।
পানির খাদ্যশৃঙ্খল বজায় রাখতে ডলফিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রতিদিন একটি প্রাপ্তবয়স্ক ডলফিনের ৩০ কেজি পর্যন্ত খাবার প্রয়োজন। এরা নদীর ছোটো ছোটো মাছ ও দুর্বল মাছকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে এবং মাছের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ডলফিন না থাকলে মাছের সংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধি পায়, ফলে মাছের মধ্যে খাদ্য গ্রহণের প্রচুর প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় এবং খাদ্য সংকট দেখা দেয়। আর দুর্বল মাছের মধ্যে রোগাক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়, ফলে ওই নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়ে। ডলফিন না থাকলে পানির খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ে। এও দেখা গেছে, ডলফিন নদীর বা পানির অনেক দূষণ নিজের শরীরের মধ্যে শোষণ করে নদী বা পানিকে দূষণমুক্ত রাখে। কোনো নদীতে ডলফিন থাকলে বোঝা যায় ওই নদীর পানি ও ইকোসিস্টেম ভালো আছে। বুদ্ধিমান এ প্রাণী স্বভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ এবং খেলোয়াড়সুলভ মানসিকতার অধিকারী, তাই অনেক দেশে ডলফিনকে খেলা দেখানো ও সামরিক কাজসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে দেখা যায়।
বর্তমানে গাঙ্গেয় ডলফিন সুন্দরবন এলাকায় সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া রাজশাহী- গোদাগাড়ী, পদ্মা-যমুনার সংযোগস্থল, চিলমারী-ভুরুঙ্গামারী, পানখালী-রূপসা-ভৈরব, ভৈরব-মেঘনা, হালদা-কর্ণফুলী-সাঙ্গু প্রভৃতি অঞ্চল ও নদীতে দেখতে পাওয়া যায়। ইরাবতী ডলফিন সুন্দরবন, উপকূলীয় অঞ্চল ও সাগরে পাওয়া যায়। তবে বিভিন্ন কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে ডলফিন ভালো অবস্থায় নেই। নদীর নাব্য হ্রাস পাওয়া, যত্রতত্র জাল দিয়ে মাছ ধরা, অবৈধ জাল ব্যবহার করা, মাছ ধরার জালে আটকে গিয়ে পানির নিচে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাওয়া, ডলফিনের আবাসস্থল সংকুচিত হওয়া, বিষ দিয়ে মাছ ধরা, অতিরিক্ত মাছ আহরণের ফলে মাছ কমে যাওয়ায় তাদের খাদ্য সংকট হওয়া প্রভৃতি কারণে ডলফিন কমে যাচ্ছে। এছাড়া নদীতে মিষ্টিপানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়া, অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণকাজ (বাঁধ ইত্যাদি) বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পানির গতিপথ পরিবর্তন হওয়া, বিভিন্ন কলকারখানার আবর্জনা ও মলমূত্র দ্বারা পানি দূষিত হওয়া, পলি পড়ে নদীর গভীরতা কমে যাওয়া, ডলফিনের গুরুত্ব সম্পর্কে না জানা প্রভৃতি কারণেও ডলফিন কমে যাচ্ছে। অনেকে কুসংস্কারবশত বাতের ওষুধ হিসেবে ব্যবহারের জন্য এবং মাছ ধরতে এটার তেল আকর্ষক হিসেবে ব্যবহারের লক্ষ্যে এগুলোকে হত্যা করে। বাংলাদেশ সরকার ডলফিনসহ সব বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বদ্ধপরিকর বলে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়টি সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ডলফিন রক্ষায় প্রয়োজনীয় আইন, বিধিমালা ও নীতিমালা করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। ডলফিন সংরক্ষণে নানা ধরনের কার্যক্রম চলমান থাকলেও এই প্রাণীগুলো এখনও হুমকির মুখে রয়েছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের দিকনির্দেশনায় বন অধিদপ্তর ডলফিন সংরক্ষণে বিভিন্নমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশের সর্ববৃহৎ ডলফিনের আবাসস্থল সুন্দরবন এলাকায় অনেকগুলো হটস্পট চিহ্নিত করে সেগুলোর মধ্য থেকে পানখালি, শিবসা আর দুধমুখিতে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু সুন্দরবনেই এ মুহূর্তে ডলফিনের জন্য ছয়টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রয়েছে। এছাড়া পাবনায় তিনটি রক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। সুন্দরবনের ডলফিন অভয়ারণ্যের ওপর নির্ভরশীল এক হাজার পরিবারকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে তাদের আয়বর্ধনমূলক কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে। মহিলাদের মধ্যে সেল্ফ-হেল্প দল গঠন করে সুন্দরবনে অবৈধভাবে মাছ ধরা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। বন অধিদপ্তরের কর্মীদের মধ্যে ডলফিন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে এবং ডলফিন অভয়ারণ্যে স্মার্ট প্যাট্রলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে ডলফিন হত্যা করলেই আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। নদী ও উপকূলীয় এলাকায় ডলফিনের সংখ্যা হ্রাস প্রতিরোধে এবং ডলফিনের আবাসস্থল রক্ষায় ডলফিন কনজারভেশন অ্যাকশন প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। শীতকালে গাঙ্গেয় ও ইরাবতী ডলফিন দেশের যেসব স্থানে দেখতে পাওয়া যায়, তা জানতে ডলফিন এটলাস ইন বাংলাদেশ প্রণয়ন করা হয়েছে।
সুন্দরবনে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে সাতটি ডলফিন সংরক্ষণ দল গঠন করা হয়েছে, যারা বনকর্মীদের সঙ্গে ডলফিন সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতি দলকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রদান করা হয়েছে, যা এফডিআর করে রাখা হয়েছে। ডলফিন কনজারভেশন টিম যাতে সরকার প্রদত্ত অর্থ সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে ডলফিন সংরক্ষণ কার্যক্রম দীর্ঘদিন চালিয়ে যেতে পারে, সেজন্য ফান্ড ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়েছে। হালদা নদীর ডলফিন সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ডলফিন ও এর আবাসস্থল সংরক্ষণ করা ছাড়াও ডলফিন সংরক্ষণকারী কর্তৃপক্ষের সহায়ক হিসেবে ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান ফর দ্য গ্যাঙ্গেজ রিভার ডলফিন ইন হালদা রিভার প্রণয়ন করা হয়েছে। ডলফিনের রিসার্চ গ্যাপ অ্যানালাইসিস করা হয়েছে এবং সে মোতাবেক ভবিষ্যতে বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেয়া হবে। সুফল প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ডলফিন সংরক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে।
অচিরেই দেশের ডলফিন অধ্যুষিত এলাকা, যেমনÑপাবনা, রাজশাহী, ভৈরব, কুড়িগ্রাম, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য এলাকায় আলোচনা সভা, প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে শুশুক মেলা আয়োজন করা হচ্ছে। স্থানীয় বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করা হয়েছে। প্রশিক্ষণে জেলেদের ডলফিন সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে জানানো, নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারে অনুৎসাহিত করা, বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করা, বন্যপ্রাণী আইন সম্পর্কে অবহিত করা, জালে ডলফিন আটকে গেলে কীভাবে নিরাপদে ডলফিনকে অবমুক্ত করা যায়, তার প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে। ডলফিনের তেল ওষুধ হিসেবে ব্যবহার বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেয়া হবে। সুন্দরবনের আদলে অন্যান্য ডলফিন বসবাসকারী এলাকায় স্থানীয় যুবকদের নিয়ে ডলফিন কনজারভেশন টিম গড়ে তোলা হবে, যাতে ডলফিন সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করতে পারে।
দেশব্যাপী ডলফিনের হটস্পট চিহ্নিত করে রক্ষিত এলাকা ঘোষণা করার উদ্যোগ নেয়া হবে। ডলফিন-সংক্রান্ত বেশ কিছু পলিসি দলিল প্রস্তুত করা হয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে ডলফিন সংরক্ষণ কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। সরকার ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২’-এর আওতায় ডলফিনসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী রক্ষার উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালের অক্টোবরে ‘দ্য সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া’ প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই এটি ‘এসডিজি গোল ১৪’-এর আওতায় জলজ প্রাণী সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে।
দেশের নদনদীর পানি ও ইকোসিস্টেম ভালো রাখতে ডলফিন সংরক্ষণ অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে ডলফিনকে শুধু একটি সাধারণ জলজপ্রাণী হিসেবে সংরক্ষণের জন্য কাজ করলে এটির সংরক্ষণ কষ্টসাধ্য। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট নদী ও উপকূলীয় এলাকা সংরক্ষণের আওতায় আনতে হবে। আর সেজন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের মধ্যে সমন্বয়সাধন এবং পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। ডলফিন সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন সোশ্যাল, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারণার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহায়তা আবশ্যক। সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলেই দেশের ডলফিন সংরক্ষণে সফলতা পাওয়া সম্ভব হবে।
পিআইডি নিবন্ধন