Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 8:26 am

ডলারের দামে ঊর্ধ্বগতির প্রভাব নিত্যপণ্যের বাজারে

শেখ আবু তালেব: ডলারের বিপরীতে টাকার চলমান অবমূল্যায়নে বেশ চাপে পড়েছে সামষ্টিক অর্থনীতির শৃঙ্খলা। আমদানি খরচ বাড়ায় এরই মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, শিশুখাদ্য, মসলা, গম, বিমানের টিকিট ও বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার খরচ। একইভাবে বেড়েছে স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদিত আমদানি পণ্যনির্ভর শিল্পের কাঁচামালের দাম। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নি¤œ ও সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে।

ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ে রপ্তানিকারকদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্থানীয় বাজারের জন্য উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ভোক্তাদের অধিক দামে পণ্য কিনতে হবে। এতে বাড়বে মূল্যস্ফীতি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ব্যাংকে ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ টাকা ৭০ পয়সা, ৯ মাস আগে গত জানুয়ারিতেও যা ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায়। আর খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য আরও বেশি ছিল। গতকাল খেলা বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৯২ টাকা।

অবশ্য টাকার অবমূল্যায়নের বিষয়টিতে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন না বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, টাকার অবমূল্যায়নটি ধীরে ধীরে হওয়া উচিত। আরও হতে পারে। এটি নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু হয়নি। বর্তমানে ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের বিনিময় মূল্যের পার্থক্য পাঁচ টাকায় পৌঁছেছে। এটি দুই টাকার মধ্যে থাকা উচিত।

ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধির একটি কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন চার মাস ধরেই প্রবাসী আয় কমে যাওয়াকে। অপরদিকে আমদানি পণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসঙ্গে করোনাকালে ডেফার্ড হওয়া এলসির দায় এখন মেটাতে হচ্ছে। বকেয়া দায় একসঙ্গে মেটাতে গিয়ে হুট করেই ডলারের চাহিদা তৈরি হয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৫ টাকা ৭০ পয়সা। রেমিট্যান্সের বিপরীতে সরকারের প্রণোদনা হিসাব করলে এ হার দাঁড়ায় ৮৭ টাকা ৪১ পয়সা। কিন্তু খোলা বাজারে বিনিময় মূল্য দাঁড়িয়েছে ৯২ টাকায়, যা অনেক বেশি।

আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া প্রসঙ্গে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে আমদানি খরচ বেড়েছে। সেইসঙ্গে ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় পণ্য উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদনকারীর খরচ বাড়বে, যার প্রভাব গিয়ে পড়বে দেশের মানুষের ওপর। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। বিশেষ করে নি¤œ ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বে। কারণ হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা বর্ধিত দামেই পণ্য বিক্রি করবেন। কিন্তু সমাজের নি¤œ, নি¤œ মধ্যাবিত্ত ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের আয় কিন্তু নির্ধারিত। তারা বেশিরভাগই বেতনভুক্ত চাকরিজীবী। তাদের আয় নির্ধারিত হওয়ায় ব্যয় বাড়াতে পারবে না। এতে ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে। এজন্য প্রবাসী আয় ও রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে হবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার ছাড়ছে, তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।

রপ্তানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) সভাপতি ও এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুস সালাম মুর্শেদি শেয়ার বিজকে বলেন, ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধিতে রপ্তানি বাজারে খুব একটা প্রভাব পড়ে না। কারণ পণ্যের কাঁচামাল আমদানি ডলারে হলেও রপ্তানি ডলারেই হয়। লভ্যাংশের অংশটুকু শুধু টাকায় রূপান্তরিত হয়। কিন্তু স্থানীয় বাজারের পণ্য উৎপাদন খরচ বাড়ে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন আমদানিকারকরা। আবার করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিদেশে যাওয়া-আসা বন্ধ ছিল। গত দেড় বছর বিদেশে কম গিয়েছে মানুষ। এমনকি চিকিৎসার জন্যও যেতে পারেননি। কিন্তু এখন প্রচুর মানুষ বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে। এতে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। একদিকে ডলারের আন্তঃপ্রবাহ কমে গেছে, পাশাপাশি ব্যাপক হারে বেড়েছে চাহিদা। এ কারণেই ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে।

বিমানের টিকিট ক্রয়ে অতিরিক্ত খরচ যোগ হচ্ছে। সব মিলিয়ে যা চূড়ান্ত ধাপে সর্বশেষ ভোক্তার ওপর বর্তায়। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সামনের দিকে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে। গত সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। গত জুলাইয়ে এ হার ছিল পাঁচ দশমিক ৫৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে পাঁচ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হারও বেড়েছে। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে এ হার ছিল পাঁচ দশমিক ৮০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় দশমিক ১৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, জ্বালানি তেল ও ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধিতে গত আগস্টেই আমদানি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৭৪ শতাংশ। এখন দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে প্রথমে পরিবহন ব্যয় ও পরে বাড়বে গণপরিবহন ব্যয়। গত বছরের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম গড়ে ছিল ৬৬ ডলার ২৫ সেন্ট। করোনার প্রকোপ শুরু হলে ১৮ মার্চ তা কমে ২৪ ডলার ৮৮ সেন্টে দাঁড়ায়। গত বছরের এপ্রিলে তা আরও কমে ২২ ডলার ২০ সেন্টে নেমে আসে। এর পর থেকে এর দামে সামান্য ওঠানামা থাকলেও গড়ে বাড়তে থাকে। গত ৩০ অক্টোবর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯ দশমিক আট ডলারে।