নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশীয় মুদ্রার মান ধরে রাখতে ডলারের দাম কমানো হয়েছে। রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ও আমদানি পরিশোধের জন্য ব্যাংকগুলো ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমিয়ে নতুন দর নির্ধারণ করেছে। এখন থেকে রপ্তানিকারকরা রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম ১১০ টাকা। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে সরকার ও ব্যাংকের প্রণোদনা মিলবে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ। আর আমদানিকারদের কাছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন এ দর আজ বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হবে।
গতকাল বুধবার ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) যৌথ সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, গত ১৫ মাস ধরে ডলারের বিপরীতে টাকাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এখন বাফেদা ও এবিবি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ডলারের বিপরীতে টাকাকে অতিমূল্যায়ন করা হবে। টাকাকে অতিমূল্যায়ন করার জন্য ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ৫০ পয়সা করে কমানো হয়েছে।
এতদিন ব্যাংকগুলোর ঘোষণা অনুযায়ী, আমদানি দায় পরিশোধে ডলারের দাম ছিল ১১১ টাকা। আর প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনার ক্ষেত্রে ডলারের ঘোষিত দাম ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। গতকাল ৫০ পয়সা করে কমিয়ে নতুন দর নির্ধারণ করা হয়।
জানা যায়, গত বছরের মার্চে ইউক্রেনে রাশিয়ায় হামলা শুরুর আগে ডলার যা খরচ হতো, তার চেয়ে বেশি জোগান ছিল। তবে যুদ্ধ শুরুর পর পণ্য ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ডলারের চাহিদাও বেড়ে যায়। শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণ করত। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব পালন করছে এবিবি ও বাফেদা। তবে সংকট না কেটে ক্রমেই তা ঘনীভূত হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক, এক্সচেঞ্জ হাউস, বাফেদা ও এবিবির সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলতে পারছে না। ফলে ডলারের বাজার নিয়ে আরও জটিলতা বাড়ছে। এতে বারবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে পরিবর্তন করা হচ্ছে ডলারের দাম। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েও তা বাতিল বা স্থগিত করা হচ্ছে।
ডলারের দাম নির্ধারণ নিয়ে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা চলছে। রেমিট্যান্সে প্রণোদনা বৃদ্ধি, পরে তা বাতিল, ব্যাংকগুলোকে ইচ্ছামতো প্রণোদনা দেয়ার স্বাধীনতা, আবার সে স্বাধীনতায় লাগাম টানা এসব নিয়ে বিশৃঙ্খল একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এতে ব্যাংক রেটের সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের রেটে ১৫-১৬ টাকার ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। এভাবেই সমন্বয়হীনতায় চলছে বর্তমানে ডলারের বাজার। তবে এভাবে চলতে থাকলে সংকট আরও বাড়বে বলে মত দিয়েছেন ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, গত ২২ অক্টোবর এবিবি ও বাফেদার অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ডলার কিনবে। তবে সরকারের ঘোষিত আড়াই শতাংশের সঙ্গে আরও আড়াই শতাংশ বাড়তি প্রণোদনা দিতে পারবে ব্যাংকগুলো।
পরের দিন ২৩ অক্টোবর থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ায় আট দিনের মাথায় তা পরিবর্তন করা হয়। ৩১ অক্টোবর আবার এবিবি-বাফেদার মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স আয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার সীমা তুলে নিয়ে ইচ্ছামতো প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করতে পারবে। তবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে গিয়ে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা।
ইচ্ছামতো প্রণোদনা দিয়ে কিছু ব্যাংক ১২২-১২৪ টাকা দামে প্রবাসী আয় কিনছে। যেসব ব্যাংকের আমদানি দায় মেটানোর চাপ আছে, তারা এই দামে ডলার কিনে দায় মেটাচ্ছে। এতে ডলারের দাম এক ধাক্কায় ১২-১৩ টাকা বেড়ে যায়। আবার কিছু ব্যাংক বাড়তি কোনো প্রণোদনাই দেয়নি রেমিট্যান্সে।
বাড়তি দামে ব্যাংকগুলোর ডলার কেনার খবর গণমাধ্যামে প্রকাশ হওয়ার পর গত ৮ নভেম্বর জরুরি সভা ডাকে বাফেদা ও এবিবি। সেখানে ৩১ অক্টোবরের সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে পালন করার তাগিদ দেয়া হয়। আর প্রবাসী আয়ে ব্যাংকের নিজস্ব ও সরকারের প্রণোদনাসহ ডলারের দর কোনোভাবে ১১৬ টাকার বেশি দেয়া যাবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়।
এরপর গত ৯ নভেম্বর এই দুই সংগঠনের ২১ প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে এবিবি ও বাফেদার নির্ধারিত দর বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।
এত সিদ্ধান্তের পরও ডলার সংকট কাটছে না। এখনও ডলার সংকট থাকার কারণে পর্যাপ্ত এলসি খুলতে পারছেন না বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। গত মঙ্গলবার এফআইসিসিআইয়ের অনুষ্ঠানে এক ব্যবসায়ী বললে, ‘বিনিয়োগ পরিবেশের কথা বলছেন! ডলার-সংকটে আমরা ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছি না।’