রোহান রাজিব: টানা দুই মাস কমতে থাকা বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি নভেম্বরে এসে কিছুটা বেড়েছে। নভেম্বর মাসে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে উঠেছে। আগের মাস অক্টোবরে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
ব্যাংকাররা বলেছেন, এপ্রিল থেকে ডলারের দাম বাড়তে থাকলেও নভেম্বরে এসে বেশি বেড়েছে। ফলে ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আগের খোলা ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তিতে অতিরিক্ত মূল্য খরচ করতে হচ্ছে। তাই বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির বাড়তে শুরু করছে। ডলারের দাম যদি আরও বাড়ে তাহলে ঋণ প্রবৃদ্ধি সামনে আরও বাড়তে থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের নভেম্বর মাসের তুলনায় ২০২২ সালের নভেম্বরে বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ব্যাংক খাত থেকে ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেশি ঋণ নিয়েছেন। বিদায়ী বছরের নভেম্বর মাসে বেসরকারি খাতে বকেয়া ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৬ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা। যা গত ২০২১ সালের একই সময়ে ছিল ১২ লাখ ৩৪ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। আর বিদায়ী বছরের অক্টোবরে ছিল ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণের একটা বিরাট অংশ আমদানির সঙ্গে জড়িত। দেখা যাচ্ছে, ডলার দর নভেম্বর থেকে বেশি বেড়েছে। ফলে ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আগের খোলা ঋণপত্র নিষ্পত্তিতে অতিরিক্ত মূল্য খরচ করতে হচ্ছে। তাই বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির বাড়তে শুরু করছে।
তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক রাখতে ব্যাংকগুলো অগ্রাধিকার খাতকে প্রাধান্য দিচ্ছে। যেমনÑকৃষি ও এসএমই। তাই এ বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ার এটাও বড় কারণ।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তাতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত অর্থবছর ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে শেষ হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ ছাড়িয়েছে ১১ দশমিক ০৭ শতাংশে উঠেছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ফেব্রুয়ারিতে এ প্রবৃদ্ধি কমে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে আসে। মার্চে তা দশমিক ৫৭ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে ওঠে। এপ্রিল মাসে তা ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশে ওঠে। মে মাসে তা আরও বেড়ে ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ওঠে। জুন মাসে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশে ওঠে। জুলাই মাসে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশে
ওঠে। আগস্টে বেড়ে ১৪.০৭ শতাংশ দাঁড়ায়। সেপ্টেম্বরে কমে ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশে। অক্টোবরে কমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশে দাঁড়ায়।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার অনেক কিছু ঠিকমতো কাজ করছে না। বেসরকারি ঋণ বৃদ্ধি পেলে মূল্যস্ফীতি বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে এতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। আর ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। তা নতুন মুদ্রানীতিতে স্বীকার করে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি গত মাসেও ছিল ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রকৃত হিসাবে তা আরও বেশি হবে।
নতুন আমদানির এলসি খোলা প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনার তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকও। তবে এলসি খোলা কমলেও ডলারের দাম বেড়েই চলছে। তাই পুরোনো ঋণপত্র খোলার পেমেন্টে বেশি খরচ হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে নতুন এলসি খোলা হয়েছে দুই হাজার ৮২৮ কোটি ডলার বা ২৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৩৭১ কোটি (৩৩ দশমিক ৭১ বিলিয়ন) ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৫৪৩ কোটি ডলার বা ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ।
তবে নতুন এলসি খোলা কমলেও চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে তিন হাজার ৩৫৪ কোটি ডলার বা ৩৩ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার এলসি নিষ্পত্তি করা হয়। গত অর্থবছরের একই সময় দুই হাজার ৭১৫ কোটি ডলার বা ২৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল। সে হিসাবে এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ কোথায় ব্যয় হচ্ছে, এটা আগে দেখতে হবে। উৎপাদন খাতে ব্যয় হলে ভালো। তাহলে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে না, তাই ব্যাংকগুলোকে উৎপাদন খাতেই ঋণ দিতে হবে।