ডলারের বিপরীতে টাকার রেকর্ড ২৬% অবমূল্যায়ন

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার সংকট প্রকট হতে শুরু করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। পরে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। তখন এ দায়িত্ব দেয়া হয় এবিবি ও বাফেদার ওপর। এরপরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি ডলারের বাজার। দফায় দফায় অবমূল্যায়ন হয়েছে টাকা। এতে গত অর্থবছরের রেকর্ড বৃদ্ধি পায় ডলারের বিনিময় হার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে দেশে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৬৮ টাকা ৮০ পয়সা। এরপর প্রতি বছর তা একটু একটু করে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে দুই বছর আবার টাকার কিছুটা অতি মূল্যায়নও হয়েছে। গত ১৪ বছরের মধ্যে ২০১১-১২ অর্থবছর সর্বোচ্চ ১১ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছিল ডলার। এরপর বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর সর্বোচ্চ ২৬ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে টাকা।

স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের পর এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন। ওই অর্থবছর ডলারের বিপরীতে টাকা ৬৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছিল। এছাড়া ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর দেশের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছিল। ওই অর্থবছর টাকার অবমূল্যায়ন হয় ২৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

এদিকে ডলারের দর বৃদ্ধির ফলে দেশে জ্বালানি তেল ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে সার্বিকভাবে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে শিল্প পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যায়। এতে শিল্পোদ্যোক্তারা বিপদে আছেন। এছাড়া ডলারের দর বৃদ্ধিতে আমদানিকারকদের পুরোনো এলসির (ঋণপত্র) দায় পরিশোধ করতে হয় বেশি দরে।

মূলত ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশে চলতি হিসাবে রেকর্ড ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কেননা বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা যত আয় করছে, তার চেয়ে ব্যয় হচ্ছে অনেক বেশি। এছাড়া কমেছে রেমিট্যান্স ও বেড়েছে আমদানি ব্যয়। ফলে ডলারে টান পড়েছে। আর এতেই কমছে টাকার মান।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে ডলারের বিনিময় হার দাঁড়ায় ৬৯ টাকা ১৮ পয়সা। ওই অর্থবছর ডলারের অবমূল্যায়ন হয়েছিল শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ। পরের অর্থবছর টাকার অবমূল্যায়ন হয় দুই দশমিক ৮৮ শতাংশ। এতে বিনিময় হার দাঁড়ায় ৭১ টাকা ১৭ পয়সা। ২০১১-১২ অর্থবছর টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছিল ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ। ওই অর্থবছর শেষে ডলারের বিনিময় হার দাঁড়ায় ৭৯ টাকা ৯ পয়সা। পরের অর্থবছর তা আরও কিছুটা বেড়ে হয় ৭৯ টাকা ৯৩ পয়সা। টাকার অবমূল্যায়ন হয় এক দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ।

পরের দুই বছর টাকার কিছুটা অতিমূল্যায়ন হয়েছে। অর্থাৎ ডলারের বিনিময় হার হ্রাস পেয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছর অতিমূল্যায়ন হয় দুই দশমিক ৭৬ শতাংশ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছর শূন্য দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ। ওই দুই বছর ডলারের বিনিময় হার কিছুটা কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৭৭ টাকা ৭২ পয়সা ও ৭৭ টাকা ৬৭ পয়সা।

২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে ডলারের বিনিময় হার আবার কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৮ টাকা ২৬ পয়সা, ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৭৯ টাকা ১১ পয়সা, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৮২ টাকা ১০ পয়সা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৮৪ টাকা দুই পয়সা। ওই অর্থবছরগুলো ডলারের অবমূল্যায়ন হয়েছিল যথাক্রমে শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশ, এক দশমিক ০৯ শতাংশ, তিন দশমিক ৭৮ ও দুই দশমিক ৩৪ শতাংশ।

পরের দুই অর্থবছর এ অবমূল্যায়নের হার ছিল খুবই সামান্য। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছর শূন্য দশমিক ৯০ ও ২০২০-২১ অর্থবছর দশমিক শূন্য দুই শতাংশ অবমূল্যায়ন হয় টাকার। ওই অর্থবছর ডলারের বিনিময় হার ছিল যথাক্রমে ৮৪ টাকা ৭৮ পয়সা ও ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। এছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছর ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা ৩০ পয়সা। অর্থাৎ টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছিল এক দশমিক ৭৭ শতাংশ।

এদিকে বিদায়ী অর্থবছর ডলারের বিনিময় হার দাঁড়িয়েছে ১০৮ টাকা ৮৪ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরে ২৬ দশমিক ১২ শতাংশ টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। ডলারের এতটা অবমূল্যায়নের পেছনে সরকারের ভুল নীতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ডা. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, কিছুটা ভুল নীতির জন্যই গত অর্থবছর ডলারের দর এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ গত ১২ বছর ধরে টাকাকে অতিমূল্যায়িত করে রাখা হয়েছিল। এখন একসঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। ফলে এত বেশি দর বৃদ্ধি পেয়েছে।

তিনি বলেন, আশপাশের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। তাই আগে বিনিময় হার সমন্বয় করা হয়নি। তবে ব্যালান্স অব পেমেন্টে বড় ঘাটতি হওয়ায় পুরো চাপটা একসঙ্গে এসেছে।

প্রসঙ্গত, গত অর্থবছর রেকর্ড ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি ছিল। তবে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে আগামীতে ডলারের দর আরও বাড়বে বলে মনে করেন ড. মনসুর। তিনি বলেন, এখনই মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে না পারলে টাকার মান কমে যাবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।

এদিকে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ী বিশেষত আমদানিকারকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান। তিনি বলেন, ‘আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় ডলারের দর এক লাফে এতটা বৃদ্ধিতে সব ধরনের পণ্যের আমদানি ব্যয় ২৫-৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এছাড়া সরকার বিলাসপণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি করেছে। কিন্তু যেসব পণ্য প্রয়োজনীয় তার দাম বেড়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডলারের দর বৃদ্ধি যদিও রপ্তানির জন্য ভালো কিন্তু আমরা আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় এটা মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ তৈরি করছে। তবে এভাবে বাড়তে থাকলে ডলারের দর কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা বলা যাচ্ছে না। আর ডলারের বাড়তি দর এখনই জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। আগামীতে আরও অন্যান্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০