ডলারের বিপরীতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে

রোহান রাজিব: বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে বিভিন্ন দেশেই ডলারের বিপরীতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) প্রতিদ্বন্দ্বী/সমকক্ষ দেশগুলোর মধ্যে এ হার সবচেয়ে বেশি ছিল বাংলাদেশে। গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ডলারের বিপরীতে প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। যদিও জুন শেষে তা দাঁড়িয়েছে ২৬ শতাংশের বেশি।

২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী/সমকক্ষ দেশগুলোর মধ্যে ভারত, চীন, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায়ও মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে। তবে তা ছিল এক থেকে চার শতাংশের মধ্যে। সে তুলনায় বাংলাদেশী মুদ্রা তথা টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের শুরুতে ডলারের বিপরীতে সময়ে বাংলাদেশের মুদ্রার গড় বিনিময় হার ছিল প্রায় ৯৩ টাকা। মার্চের শেষে গিয়ে এ হার দাঁড়ায় ১০৪.৬৬ টাকা। অর্থাৎ মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়। এরপর ভারতের বেশি অবমূল্যায়ন হয়। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে দেশটির মুদ্রার (রুপি) অবমূল্যায়ন হয় ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর চীনের মুদ্রার (ইউয়ান) এ ৯ মাসে অবমূল্যায়ন করা হয় ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ভিয়েতনামের মুদ্রার (ডং) অবমূল্যায়ন হয় ১ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ার মুদ্রার (রুপিয়া) অবমূল্যায়ন হয় ১ দশমিক ৪২ শতাংশ।

যদিও ওই সময় মার্কিন মুদ্রার বিপরীতে দুই দেশের মুদ্রা আরও শক্তিশালী তা অতিমূল্যায়ন হয়। দেশ দু’টি হলোÑফিলিপাইন্স ও কম্বোডিয়া। ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ডলারের বিপরীতে ফিলিপাইনের মুদ্রা (পেসো) ১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ অতি মূল্যায়ন হয়েছে। আর কম্বোডিয়ার মুদ্রা (কম্বোডিয়ান রিয়াল) অতি মূল্যায়ন হয়েছে শূন্য দশমিক ৯৬ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদনে বলেছে, গত অর্থবছর বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে চাহিদা-সরবরাহের ব্যবধান থাকায় আকস্মিকভাবে টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়। ডলার সংকট থাকার কারণে ব্যাংকগুলো চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছে না। তাই নিয়মিত রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করতে হয়েছে। এর ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে ১০ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের জুন শেষে মোট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আর চলতি বছরের মার্চ শেষে তা কমে ৩১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস (জুলাই-মার্চ) সময়কালে আমদানি কমেছে ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি ১৪ দশমিক ৬১ বিলিয়ন কমাতে সাহায্য করেছে। যদিও আগের অর্থবছরের একই সময় বাণিজ্য ঘাটতি ২৫ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার ঋণাত্মক ছিল।

সূত্রমতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার সংকট প্রকট হতে শুরু করে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। পরে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। তখন এ দায়িত্ব দেয়া হয় এবিবি ও বাফেদার ওপর। এরপরও নিয়ন্ত্রণে আসেনি ডলারের বাজার। দফায় দফায় অবমূল্যায়ন হয়েছে টাকা। এতে গত অর্থবছরের রেকর্ড বৃদ্ধি পায় ডলারের বিনিময় হার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর শেষে দেশে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৬৮ টাকা ৮০ পয়সা। এরপর প্রতি বছর তা একটু একটু করে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে দুই বছর আবার টাকার কিছুটা অতি মূল্যায়নও হয়েছে। গত ১৪ বছরের মধ্যে ২০১১-১২ অর্থবছর সর্বোচ্চ ১১ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছিল ডলার। এরপর বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছর সর্বোচ্চ সাড়ে ২৫ শতাংশের বেশি অবমূল্যায়ন হয়েছে টাকা।

১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের পর এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অবমূল্যায়ন। ওই অর্থবছর ডলারের বিপরীতে টাকা ৬৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছিল।

এদিকে ডলারের দর বৃদ্ধির ফলে দেশে জ্বালানি তেল ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে সার্বিকভাবে আমদানি খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে শিল্প পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যায়। এতে শিল্পোদ্যোক্তারা বিপদে আছেন। এছাড়া ডলারের দর বৃদ্ধিতে আমদানিকারকদের পুরোনো এলসির (ঋণপত্র) দায় পরিশোধ করতে হয় বেশি দরে।

মূলত ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশে চলতি হিসাবে রেকর্ড ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কেননা বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা যত আয় করছে, তার চেয়ে ব্যয় হচ্ছে অনেক বেশি। এছাড়া কমেছে রেমিট্যান্স ও বেড়েছে আমদানি ব্যয়। ফলে ডলারে টান পড়েছে। আর এতেই কমছে টাকার মান।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ডা. আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, কিছুটা ভুল নীতির জন্যই গত অর্থবছর ডলারের দর এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ গত ১২ বছর ধরে টাকাকে অতিমূল্যায়িত করে রাখা হয়েছিল। এখন একসঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। ফলে এত বেশি দর বৃদ্ধি পেয়েছে।

তিনি বলেন, আশপাশের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। তাই আগে বিনিময় হার সমন্বয় করা হয়নি। তবে ব্যালান্স অব পেমেন্টে বড় ঘাটতি হওয়ায় পুরো চাপটা একসঙ্গে এসেছে।

প্রসঙ্গত, গত অর্থবছর রেকর্ড ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি ছিল। তবে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে আগামীতে ডলারের দর আরও বাড়বে বলে মনে করেন ড. মনসুর। তিনি বলেন, এখনই মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে না পারলে টাকার মান কমে যাবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।

এদিকে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ী বিশেষত আমদানিকারকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান। তিনি বলেন, ‘আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় ডলারের দর এক লাফে এতটা বৃদ্ধিতে সব ধরনের পণ্যের আমদানি ব্যয় ২৫-৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এছাড়া সরকার বিলাসপণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি করেছে। কিন্তু যেসব পণ্য প্রয়োজনীয় তার দাম বেড়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডলারের দর বৃদ্ধি যদিও রপ্তানির জন্য ভালো কিন্তু আমরা আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় এটা মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ তৈরি করছে। তবে এভাবে বাড়তে থাকলে ডলারের দর কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা বলা যাচ্ছে না। আর ডলারের বাড়তি দর এখনই জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। আগামীতে আরও অন্যান্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০