ডলারে ক্যাপাসিটি চার্জ শোধে ৩৫% বাড়তি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পকেটে!

ইসমাইল আলী: ২০২২ সালের মে থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার আনুষ্ঠানিক অবমূল্যায়ন শুরু হয়। এ সময় ডলারের বিনিময় হার ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ঠেকেছে ১২০ টাকায়। টাকার এ অবমূল্যায়নের প্রভাব সরাসরি পড়েছে বিদ্যুৎ খাতে। বেড়ে গেছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ব্যয়। শুধু ডলারের বিনিময় হারের কারণে গত অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ৩৫ শতাংশ বাড়তি অর্থ পকেটে ভরেছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছর বেসরকারি খাতে রেন্টাল ও আইপিপিগুলোর (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছিল ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছর এ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে ২৩ হাজার ৯৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ব্যয় বেড়েছে পাঁচ হাজার ৯৪১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বা ৩৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। শুধু ডলারে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের কারণে এ অর্থ গচ্চা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্যাপাসিটি চার্জের ক্ষেত্রে মূলত দুটি অংশ থাকে। একটি অংশ নন-এসকেলেবল ও অপরটি এসকেলেবল। মূলত ক্যাপিটাল মেশিনারিজ তথা মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যয় নন-এসকেলেবল অংশে অন্তর্ভুক্ত থাকে। আর বাংলাদেশের প্রায় সব বিদ্যুৎকেন্দ্র যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে দেশীয় মুদ্রায় ঋণ নিয়েছে। তাদের এ ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে দেশীয় মুদ্রায়। তবে তারা ক্যাপাসিটি চার্জ নিচ্ছে ডলারের রেটে। ফলে বাড়তি অর্থ ঢুকছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পকেটে।

একটি উদাহরণ দিয়ে এর বিশ্লেষণ করেন পিডিবির কর্মকর্তারা। তারা জানান, যদি একটি বিদ্যুৎ কোম্পানি ২০১৮ সালে ১০০ মিলিয়ন ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানি করে থাকে তবে তার ঋণের পরিমাণ ছিল ওই সময়ের বিনিময় হারের (৮০ টাকা) ভিত্তিতে ৮০০ কোটি টাকা। যন্ত্রপাতি আমদানি মূল্য বিবেচনা করে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করলে পিডিবিকে ৮০০ কোটি টাকাই পরিশোধ করতে হবে। একটি নির্ধারিত সময়ে (যেমন ২০ বছরে) পিডিবি কিস্তিতে তা পরিশোধ করবে।

এদিকে ডলারের বিনিময় হার বর্তমানে ১২০ টাকা দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে (৬ বছরে) কোম্পানিটি ১৬০ কোটি টাকা ঋণ শোধ করে থাকলে তার ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৪০ কোটি টাকা। তবে ডলারে হিসাব করলে ২০ মিলিয়ন পরিশোধ করে থাকলে তার ঋণের পরিমাণ বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৮০ মিলিয়ন ডলার বা ৯৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণ ১৬০ কোটি টাকা না কমে উল্টো ১৬০ কোটি টাকা বেড়ে গেছে। এতে পিডিবিকে পরবর্তী ১৪ বছরে ক্যাপাসিটি পরিশোধের পরিমাণ বাড়াতে হবে।

ডলারের ভিত্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ ধরায় পিডিবির দায় এখানেই শেষ নয়। আগামীতে ডলারের বিনিময় হার যত বাড়বে পিডিবিকে তত বেশি হারে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। যদিও বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিটি ব্যাংককে ৮০০ কোটি টাকাই শোধ করবে। তবে ডলারের রেট ধরে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করায় বিদ্যুৎ কোম্পানিটির পকেটে ২০ বছরে আরও হয়তো বাড়তি ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা ঢুকে যাবে। এভাবে নিয়মিতই গচ্চা যাচ্ছে পিডিবির তথা সরকারি অর্থ। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে যাচ্ছে। অথচ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও পিডিবির লোকসান কমানো যাচ্ছে না। বরং প্রতি বছর লোকসান বাড়ছে।

ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর জুনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বৈঠকে একটি প্রতিবেদনে উপস্থাপন করে পিডিবি। এতে বলা হয়েছিল, ডলারের বিনিময় হার ৮৬ টাকা থাকলে ২০২২-২৩ অর্থবছর পিডিবির সম্ভাব্য লোকসান দাঁড়াত ৩৯ হাজার কোটি টাকা। তবে ডলারের দর ১০৭ টাকা হলে এ লোকসান বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ শুধু ডলারের অবমূল্যায়নের জন্য লোকসান বেড়ে যাবে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, ২০০৯ সাল থেকে বেশকিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয় সরকার। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ডলারে। যদিও বর্তমানে কুইক রেন্টালের সংখ্যা কমে এসেছে, তারপরও বিদ্যমান কেন্দ্রগুলোকে ডলারেই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের পর বেসরকারি খাতে বড় বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। আইপিপি নামক এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারের বিনিময় হার ধরে টাকায় পরিশোধ করতে হয়। অর্থাৎ বিনিময় হার যত বাড়ে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ব্যয়ও তত বাড়ে।

ওই বৈঠকে পিডিবি আরও জানায়, ডলারের এক টাকা বিনিময় হার বৃদ্ধিতে পিডিবির লোকসান বাড়ে বছরে ২৩০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে করণীয় কীÑজানতে চাইলে পিডিবির কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, যেসব বিদ্যুৎ কোম্পানির বৈদেশিক ঋণ আছে, তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারের বিনিময় হার ধরে পরিশোধ করা যেতে পারে। কারণ ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। তবে যেসব কোম্পানির বৈদেশিক ঋণ নেই, বরং দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে তাদের ক্ষেত্রে চুক্তি সংশোধন করতে হবে। এক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় মূল্য বাদ দিয়ে সরাসরি দেশীয় মুদ্রায় ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করতে হবে।

যদিও পিডিবির কর্মকর্তাদের ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। ওই বৈঠকে উপস্থিত পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটা শনাক্ত করা খুবই সহজ। কোন কোম্পানি কোন উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে তা পিডিবিতে দাখিল করতে হবে। পিডিবি তা যাচাই-বাছাই করে চুক্তি সংশোধনের সুপারিশ করবে। কেউ বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিলে ডলারের বিনিময় হারে ক্যাপাসিটি চার্জ পাবে। আর যারা দেশের অভ্যন্তরের উৎস থেকে ঋণ নিয়েছে তাদের এলসি খোলার রেট ধরে ঋণের পরিমাণ স্থির করে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করতে হবে। কেউ যদি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় উৎস থেকে ঋণ নেয় তাহলে তার ক্যাপাসিটি চার্জ বিদেশি উৎসের অংশ ডলারে ও দেশীয় উৎসের অংশ টাকায় নির্ধারণ করতে হবে। এটি করতে পারলে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ব্যয় ৩৫ শতাংশ কমিয়ে আনা যাবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০