ইসমাইল আলী: ঘাটতি দ্রুত মেটাতে ২০০৯ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছর বেশকিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয় সরকার। তিন ও পাঁচ বছর মেয়াদি ছাড়াও ১৫ বছর মেয়াদি কয়েকটি কেন্দ্র্র স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয় সে সময়। যদিও এসব কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। আবার এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জও পরিশোধ করতে হয় ডলারে।
এক যুগের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এ নিয়ে টনক নড়েনি কারোরই। তবে সাম্প্রতিক ডলার সংকটের কারণে বিষয়টি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয় তথা সরকারের। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বৈদেশিক ঋণ নেই, তাদের চুক্তি সংশোধনের প্রস্তাব করেছে পিডিবি।
সূত্র জানায়, ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ১১ বছরে শুধু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। আর বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছর এ ব্যয় ছিল আরও প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ১২ বছরে পিডিবিকে এ খাতে ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। আর এ বিলের পুরোটাই গেছে ডলারে। যদিও বর্তমানে কুইক রেন্টালের সংখ্যা কমে এসেছে, তার পরও বিদ্যমান কয়েকটি কেন্দ্রকে ডলারেই ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে।
এদিকে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের পর বেসরকারি খাতে বড় বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) নামক এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ সরাসরি ডলারে পরিশোধ করা হয় না। তবে আইপিপিগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারের বিনিময় হার ধরে টাকায় পরিশোধ করতে হয়। এক্ষেত্রে বিনিময় হার নির্ধারিত হয় সোনালী ব্যাংকের বিনিময় হারে। ফলে সরাসরি ডলার না গেলেও গত কয়েক মাসের টাকার অবমূল্যায়নে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ ব্যয় বেড়ে গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক বৈঠকে পিডিবি জানায়, ডলারের এক টাকা বিনিময় হার বৃদ্ধিতে পিডিবির লোকসান বাড়ে বছরে ২৩০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে করণীয় কীÑজানতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা বলেন, যেসব কোম্পানির বৈদেশিক ঋণ আছে, তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ ডলারের বিনিময় হারে পরিশোধ করা যেতে পারে। কারণ ডলারের মূল্য বৃদ্ধিতে ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। তবে যেসব কোম্পানির বৈদেশিক ঋণ নেই তাদের ক্ষেত্রে চুক্তি সংশোধন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় মূল্য বাদ দিয়ে সরাসরি দেশীয় মুদ্রায় ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা যেতে পারে। এজন্য চুক্তি সংশোধন করতে হবে।
যদিও বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান পিডিবির কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগ ও অর্থ বিভাগের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। পিডিবির চেয়ারম্যানও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আর বৈঠকে উপস্থিত পিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, চলতি বছর ডলারের বিনিময় হার ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। বছরের শুরুতে এ হার ছিল ৮৫ টাকা। অর্থাৎ বিনিময় হার ১৫ টাকা বাড়বে। এতে পিডিবির লোকসান অনেক বাড়বে। তাই চুক্তি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বিষয়টি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়।
সূত্র জানায়, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থাপনের সময় বেসরকারি মালিকদের মূলধনি ব্যয় সংস্থানে সরকার ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থাপনে বেসরকারি উদ্যোক্তারা মোট ব্যয়ের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাংক ঋণ সুবিধা পেয়েছিল। বাকি ২০ শতাংশ ইক্যুইটি হিসেবে নিজস্ব অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। আর ওই ব্যাংকঋণ পরিশোধের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণব্যয় বিবেচনায় ক্যাপাসিটি চার্জের হার নির্ধারণ করা হয়েছিল।
যদিও দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণে নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি নেই। সাধারণত বিদ্যুৎকেন্দের নির্ধারিত মেয়াদ (তিন বা পাঁচ বছর) শেষে অবচয়িত মূল্য বাদ দিয়ে বাকি অংশের নেট বর্তমান মূল্য ও ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন (আইআরআর) হিসাব করে ক্যাপাসিটি চার্জের হার নির্ধারণ করতে হয়। তবে দেশের এ হার নির্ধারণে বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে উদ্যোক্তাদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে দরকষাকষির ভিত্তিতে বছরভিত্তিক ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়া সরাসরি লাইসেন্স দেয়ায় এমনিতেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্মাণব্যয় অনেক বেশি ধরা হয়েছে। ফলে ক্যাপাসিটি চার্জের হারও অনেক বেশি ছিল। তবে এসব কেন্দ্রের চুক্তি বারবার নবায়ন করে বারবার ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে তাদের মূলধনি ব্যয়ের কয়েকগুণ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। এ সুযোগে বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলো সব ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। আর বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বেঁচে লোকসানে ডুবেছে পিডিবি।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০১০-১১ অর্থবছরে স্থাপিত রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ছিল এক হাজার ৭০৩ মেগাওয়াট। আর এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় এক হাজার ৩৭১ কোটি ২১ লাখ টাকা। পরের (২০১১-১২) অর্থবছর স্থাপিত রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ১৭৪ মেগাওয়াট। এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় তিন হাজার ৪৩৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
২০১২-১৩ অর্থবছরে স্থাপিত রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষমতা একই ছিল। তবে উৎপাদন সক্ষমতা কিছুটা কমে দাঁড়ায় দুই হাজার ১৬৯ মেগাওয়াট। আর সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় তিন হাজার ৮৭০ কোটি সাত লাখ টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরও রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা একই ছিল। তবে মেয়াদশেষে তিন বছর মেয়াদি কুইক রেন্টালগুলোর চুক্তি নবায়নের সময় ক্যাপাসিটি চার্জের হার কিছুটা কমানো হয়। এতে সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় তিন হাজার ২১৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে স্থাপিত রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা কিছুটা কমে দাঁড়ায় দুই হাজার ১৫৬ মেগাওয়াট। সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় তিন হাজার ১৭১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। পরের বছর বন্ধ হয়ে যাওয়া আরও বেশকিছু রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করা হয়। এতে ২০১৫-১৬ অর্থবছর রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ১৯৬ মেগাওয়াট। তবে চুক্তি নবায়নের সময় ক্যাপাসিটি চার্জের হার আরও কিছুটা কমানো হয়। এতে সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় দুই হাজার ৭৯১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
২০১৬-১৭ অর্থবছরেও রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা একই ছিল। আর সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় দুই হাজার ৬৩৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। পরের বছর বেশকিছু রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। এতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা আরও কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৮৯৪ মেগাওয়াট। আর সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করা হয় দুই হাজার ৪৭০ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা এক হাজার ৮৯৪ মেগাওয়াটই ছিল। আর সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ কমে দাঁড়ায় দুই হাজার ১১৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এর পরের বছর ডিজেলচালিত কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা হয়। তবে গ্যাস ও ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে থাকে। এতে ২০১৯-২০ অর্থবছর রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৪৫৯ মেগাওয়াট। আর সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা।
২০২০-২১ অর্থবছর রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা আরও কমে দাঁড়ায় এক হাজার ২৫৯ মেগাওয়াট। আর সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ কমে দাঁড়ায় এক হাজার ২৭৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। বিদায়ী অর্থবছরও এ খাতে ব্যয় হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি থাকবে বলেই জানান পিডিবি সংশ্লিষ্টরা।