ডলার বিক্রি ও আকুর দায় শোধে পতন হচ্ছে রিজার্ভ

রোহান রাজিব: দেশে ডলার সংকট পুরোপুরি কাটেনি। তাই আমদানি দায় পরিশোধ করতে ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করার জন্য ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে রেকর্ড ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। পাশাপাশি আগামী সোমবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল সময়ের ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বড় ধরনের পতন হতে যাচ্ছে। আকু বিল পরিশোধের পর সাত বছর পর রিজার্ভ ৩০ বিলিয়নের নিচে নেমে আসবে। এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে রিজার্ভ ছিল ৩০ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার।

কভিড-১৯ পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে, খরচ হচ্ছে সে তুলনায় বেশি। বাড়তি চাহিদা মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ধারাবাহিকভাবে কমছে রিজার্ভ। গতকাল বুধবার দিন শেষে রিজার্ভ ৩০ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত বছর মে মাসে রিজার্ভ ছিল ৪২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ১১ বিলিয়ন ডলার। দেশের ইতিহাসে রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে ২০২১ সালের আগস্টে।

গতকাল বুধবার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ৫ কোটি ৫ লাখ (৫৫ মিলিয়ন) ডলার বিক্রি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছর বিক্রি করা হয় ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। এভাবে ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে টাকা উঠে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এতে রিজার্ভ কমার পাশাপাশি টাকার তারল্যেও চাপ তৈরি হয়েছে। এ অবস্থার উন্নয়নে আমদানি দায় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করতে দ্রুত দর বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত মঙ্গলবার ডলারের দর দেড় টাকা বাড়িয়ে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ১০৩ টাকায় ডলার বিক্রি শুরু করেছিল, যা আগে ১০২ টাকা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ডলারের দর বৃদ্ধি হয়েছে ২১ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুটি প্রধান কারণে দ্রুতহারে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করছে। এর মধ্যে একটি হলো রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির চাপ কমানো। আরেকটি কারণ হলোÑকেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি ইউনিফায়েড এক্সচেঞ্জ রেট প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রয়েছে।

বর্তমানে বাজারে ডলারের বেশ কয়েকটি রেটের প্রচলন আছে। ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রপ্তানিকারকরা রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের দাম পাবেন ১০৬ টাকা। প্রবাসী আয়ে ডলারের দাম হবে ১০৮ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পেতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারের ওপরে রাখতে হবে। কিন্তু আকুর দায় পরিশোধ করার পর তা ২২ বিলিয়নের ঘরে চলে যাবে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইএমএফের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি জুনের পর থেকে করা হবে বলে বলা হয়েছে। আইএমএফ থেকে বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী রিজার্ভ গণনা করতে হবে। যেটুকু ইতোমধ্যে ব্যবহার হয়েছে তা রিজার্ভের গণনায় আনা যাবে না। প্রসঙ্গত, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল, বিমানের ঋণ, পায়রা বন্দরসহ বেশ কয়েকটি খাতে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়া হয়েছে। আইএমএফ বলছে, এ অর্থ রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে হবে। আকুর দায় পরিশোধের পর গ্রস রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যাবে। আইএমএফের হিসাব আমলে নিলে গ্রস থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে তা ২২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে যাবে।

নিট রিজার্ভের পতন ঠেকাতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) আকার দ্রুত কমাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চার মাসের ব্যবধানে রপ্তানিকারকদের সহায়তা দিতে গঠন করা এ তহবিলের আকার ২০০ কোটি বা ২ বিলিয়ন ডলার কমানো হলো। চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম দিকে এ তহবিলের আকার ছিল ৭ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের ঋণের পুরোটা পেতে সংস্থাটির কথামতো জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে ইডিএফের আকার কমিয়ে ৬ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে তা থেকে আরও ৫০ কোটি ডলার কমিয়ে ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হয়। এরপর দুই দফায় আরও ৫০ কোটি ডলার কমিয়ে শেষ পর্যন্ত ৫ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে গ্রাহক থেকে আদায় হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা সমন্বয় দেখানো হচ্ছে। নতুন ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রেও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। যথাসময়ে ফেরত না দিলে দণ্ড সুদের বিধান করা হয়েছে। ইডিএফ থেকে একক প্রতিষ্ঠানের ঋণসীমা সব পর্যায়ে ৫০ লাখ ডলার কমানো হয়েছে। নানা কড়াকড়ির পাশাপাশি ইডিএফের আদলে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ব্যয় কমানোর জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এতে অর্থবছরের প্রথম আট মাসে আমদানি প্রবৃদ্ধি কমে নেমেছে ঋণাত্মক প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশে, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৫০ শতাংশ। এ হিসাবে এক বছরে আমদানি কমেছে ৬০ শতাংশ। কিন্তু এরপরেও রিজার্ভ কমে যাওয়ার ধারাবাহিকতা ঠেকানো যাচ্ছে না।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শেয়ার বিজকে বলেন, রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা হয় আমদানি চাহিদা মেটানোর জন্য। ব্যাংকগুলোকে যাচাই-বাছাই করেই ডলার দেয়া হয়। দেশের রিজার্ভ বাড়া-কমার মধ্যে থাকবে, এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই রিজার্ভ পরিবর্তিত হয়। তেমনই মে মাসে আকু পেমেন্টও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি রুটিন কাজ। এটি নিয়ে আলাদা করে আলোচনার কিছু নেই।

হঠাৎ আকু দায় বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন আগের চেয়ে বেশি এলসি খোলা হচ্ছে। তাই আকুর দায়ের পরিমাণ বাড়ছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০