ডলার সংকটেও প্রবাসী তিন বন্ডে বিনিয়োগে খরা

রোহান রাজিব: দেশে তীব্র ডলার সংকটেও সরকারের প্রবাসী তিন বন্ডে বিনিয়োগে খরা। এসব বন্ডে বিনিয়োগ করার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা এখন বেশি। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে প্রবাসী তিন বন্ডের নিট বিক্রির পরিমাণ ‘ঋণাত্মক’ হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রবাসীরা নতুন করে বন্ডে বিনিয়োগের চেয়ে আগেরগুলো ভেঙে ফেলছেন বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ৪৬৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকার বন্ড বিক্রি হয়েছে। আর এ সময়ে ভাঙিয়েছেন এক হাজার ১১৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এতে বোঝা যাচ্ছে, এ খাতে থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া তো দূরে থাক, নিট কমেছে ৬৫২ কোটি ৭২ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, কভিড-পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মুদ্রার মূল্যমানে বড় পরিবর্তন এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সারাবিশ্বে সুদহার বেড়েছে। এর মধ্যে অন্যতম মার্কিন বন্ডের সুদহার বাড়ানো হয়। এর ফলে অন্যান্য দেশে এর প্রভাব পড়েছে। যার প্রভাব বাংলাদেশের প্রবাসী বন্ডের ওপর একটা চাপ তৈরি হয়েছে। তাই মানুষ প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি তারা এসব বন্ড ভেঙে যেসব দেশে সুদহার বেশি সেখানে বিনিয়োগ করেছে।

বর্তমানে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্টÑএ তিন ধরনের প্রবাসী বন্ড রয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের আগে প্রবাসীরা এসব বন্ডে যেকোনো পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারতেন। ওই বছরের ৩ ডিসেম্বর এক নির্দেশনার মাধ্যমে তিন ধরনের বন্ড মিলে সমন্বিত বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করা হয় এক কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের মধ্যে গত এপ্রিলে ইউএস ডলার প্রিমিয়াম ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেয়া হয়েছে। আর ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে এক কোটি টাকার ঊর্ধ্বসীমা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে বিনিয়োগের বিপরীতে সুদহার কমানো হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে চাপের সময়ে সুদহারে পরিবর্তন আনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন অর্থনীতিবিদরা।

তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড বিক্রি হয়েছে ২৮৯ কোটি ৮ লাখ টাকা। এ সময়ে ভাঙানো হয়েছে ৭৯৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর ফলে নিট বিক্রি কমেছে ৫০৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এছাড়া ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের নিট বিক্রিও কমেছে। পাঁচ মাসে নিট বিক্রি কমেছে ১৫৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এ সময়ে প্রবাসীরা ১১৩ কোটি ২ লাখ টাকা জমা করেছে। আর ভাঙিয়েছে ২৬৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ফলে নিট বিক্রি কমেছে।

অন্যদিকে ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড নিট বিক্রি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে এ বন্ডে বিনিয়োগ হয়েছে ৬৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এ সময়ে ভাঙানো হয় ৫১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ নিট বিক্রি বেড়েছে ১১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, আগে মেয়াদ শেষ হলে বন্ডগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নবায়ন হতো। এখন নবায়নের জন্য গ্রাহকদের ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউসে যেতে হয়। তাই নবায়নের হার কমে গেছে। অন্য দিকে নগদায়ন বা বন্ড ভাঙানোর প্রবণতা বেড়ে গেছে। আবার যাদের বেশি বিনিয়োগ ছিল, তারাও বিনিয়োগ কমিয়ে ফেলছেন। এসব বন্ডে বিনিয়োগের বড় অংশই প্রবাসী ব্যবসায়ীদের।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। প্রবাসীদের আয় কমে গেছে। এসব বন্ড থেকে যে সুদ পাওয়া যাচ্ছে সেটি চলে গেছে মূল্যস্ফীতির নিচে। যারা বিনিয়োগ করবে তারা দেখছে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশে বেশি হয়ে গেছে। ডলারে বিনিয়োগ করে তারা রিটার্ন পাচ্ছে টাকায়। কমে গেছে টাকার মূল্যমান। রেমিট্যান্স কমে যাওয়াও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার একটি কারণ বলে মনে করেন তিনি।  

সুদহার কমানোর আগে যেকোনো অঙ্কের ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে পাঁচ বছরের জন্য ১২ শতাংশ সুদ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে সুদহার অপরিবর্তিত থাকলেও ১৫ লাখের বেশি থেকে ৩০ লাখ ১১ শতাংশ, ৩০ লাখ টাকার বেশি থেকে ৫০ লাখ পর্যন্ত ১০ শতাংশ এবং ৫০ লাখ টাকার বেশি হলে ৯ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করা হয়েছে।

তিন বছর মেয়াদি ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে আগে ৬ শতাংশ সুদ পাওয়া যেত। বর্তমানে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ৫ শতাংশ, এক লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ৪ শতাংশ এবং এর বেশি হলে ৩ শতাংশ সুদ দেয়া হচ্ছে। তিন বছর মেয়াদি ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডে আগে সাড়ে ৭ শতাংশ সুদ পাওয়া যেত। এখন ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের তুলনায় প্রতি পর্যায়ে দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি সুদ মিলছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, গ্লোবাল মার্কেটের বন্ডের সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে দেশের প্রবাসী বন্ডের বিনিয়োগে ওপর প্রভাব পড়েছে। কারণ মার্কিন সুদহার বেড়ে গেছে। এর ফলে দেশের প্রবাসীরা এখানে কম রেট পাচ্ছে। ফলে তারা দেশে বিনিয়োগ না করে যেখানে রেট বেশি সেখানে বিনিয়োগ করছে। তাই দেশে প্রবাসী বন্ডের বিনিয়োগ কমে গেছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০