ডলার সংকট বেড়েই চলেছে। এতে শিল্পপণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলা যাচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্প উৎপাদন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিত্যপণ্যের আমদানিতে ডলার সংকট। জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ আমদানিতেও ডলার দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এ নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে শেষ পর্ব
ইসমাইল আলী: দেশের সাম্প্রতিক ডলার সংকট থেকে মুক্ত নেই কোনো খাতই। যদিও অগ্রাধিকার খাত হিসেবে খাদ্য ও জ্বালানি পণ্য আমদানিতে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। তবে বাস্তবে তার উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। ডলার সংকটে গত বছর (২০২২ সাল) ফার্নেস অয়েল ও এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি অনেক কমে যায়। বিশেষ করে এলএনজি আমদানিতে ধস নেমেছে।
জ্বালানি সংকটের প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ খাতে। গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল না পেয়ে বন্ধ রাখা হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে মাঘের শীতেও হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হচ্ছে।
অন্যদিকে ডলার সংকটের প্রভাব থেকে মুক্তি পাচ্ছে না রমজানের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি। ডিসেম্বরে এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে ডলার পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। মুসলমানদের আরেক ধর্মীয় বিধান হজেও ডলার সংকটের প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করছে সরকার।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যমতে, ২০২১ সালে দেশে ফার্নেস অয়েল আমদানি হয়েছিল ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার ৬২১ দশমিক ৭৪ মেট্রিক টন। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৭০ হাজার ২৯৩ দশমিক ৭৩ মেট্রিক টন। অর্থাৎ আমদানি কমেছে প্রায় তিন লাখ ৮৬ হাজার ৩২৮ মেট্রিক টন বা সাত দশমিক ৯৫ শতাংশ। আর ২০২১ সালে দেশে এলএনজি আমদানি হয়েছিল ৫০ লাখ ১৫ হাজার ৬২৭ দশমিক ১২ মেট্রিক টন। ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র তিন লাখ ১২ হাজার ২২৮ মেট্রিক টন। অর্থাৎ আমদানি কমেছে ৪৭ লাখ তিন হাজার ৩৯৯ দশমিক ১২ মেট্রিক টন বা ৯৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল না পেয়ে বন্ধ হয়ে গেছে বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর মধ্যে ১৬ জানুয়ারি আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ ছিল ৬৬টি কেন্দ্র, যার ২১টি গ্যাসচালিত ও ৪৫টি ফার্নেস অয়েলচালিত। এছাড়া কয়লা সংকটে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও বন্ধ ছিল। এর
প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। ওইদিন (২ মাঘ) দেশে হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়। ওই দিন সন্ধ্যা ৭টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৯ হাজার ৯৯৭ মেগওয়াট ও উৎপাদন হয় আট হাজার ৯০২ মেগাওয়াট। এতে লোডশেডিং করা হয় উৎপাদন পর্যায়ে এক হাজার ৯৫ মেগাওয়াট।
১৭ জানুয়ারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের সংখ্যা বেড়ে যায়। ওই দিন আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ ছিল ৭২টি কেন্দ্র। এর মধ্যে ২৬টি গ্যাসচালিত ও ৪৬টি ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্র রয়েছে। পাশাপাশি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রও বন্ধ ছিল। এর প্রভাব পড়েছে ওইদিনের বিদ্যুৎ উৎপাদনে। সেদিন (২ মাঘ) দেশে সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয় দুপুর দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত। পুরো সময় ধরেই লোডশেডিং করা হয় এক হাজার ২৫৫ মেগাওয়াট।
জ্বালানি সংকটের মতো ভোগ্যপণ্য আমদানিতেও পড়েছে ডলার সংকটের প্রভাব। বিশেষ করে রমজানের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। এজন্য একাধিক বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রোজায় পণ্য সরবরাহ সংকট হতে পারে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। সমস্যা সমাধানে অর্থ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ করা হচ্ছে। কিন্তু ডলার সংকটের সমাধান মিলছে না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এবারের রমজানে চাহিদা মেটাতে তেল, চিনি, ছোলা, খেজুরসহ প্রয়োজনীয় ছয়টি ভোগ্যপণ্য আমদানিতে প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের দরকার হবে। এর মধ্যে ৯৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার ব্যয় হবে ৭ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানিতে, ৮১ কোটি ২০ লাখ ডলার ব্যয় হবে ২২ লাখ টন গম এবং ৩৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয় হবে ৮ লাখ টন চিনি আমদানিতে। এছাড়া ২ লাখ ১০ হাজার টন ছোলা আমদানিতে ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার, ১ লাখ ৫৭ হাজার টন মসুর ডাল আমদানিতে ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং ৫৯ হাজার টন খেজুর আমদানিতে ৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার ব্যয় হবে।
রমজানে প্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিতে ডলার সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর আবারও চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে গত ১৪ ডিসেম্বর গভর্নরকে একই অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছিল। এছাড়া ১২ ডিসেম্বর এফবিসিসিআই সভাপতির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোজার আগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার সংস্থানের দাবি জানান।
জানা গেছে, দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ চিনি, ছোলা, তেলসহ সাত ধরনের পণ্য আমদানির চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। গ্রুপটি দেশের ২৮টি ব্যাংকে যোগাযোগ করে ডলার সংকটে এলসি খুলতে পারেনি। সিটি গ্রুপ মোট ৩৮ কোটি ৫২ লাখ ডলার সমপরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি পণ্যের জন্য এলসি খুলতে না পেরে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হয়।
এদিকে ডলার সংকটের প্রভাব এবার হজের খরচে পড়বে বলেই মনে করছেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। ১৫ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘কোনো অবস্থায়ই আমরা হজের খরচ বাড়াতে চাই না। যে ব্যয় গত বছরে হয়েছিল, সেটাই রাখার চিন্তা করছি। তারপরও কিন্তু খরচ বাড়বে। কেন বাড়বে সেটা বলি, সৌদি রিয়ালের দাম গত বছর ছিল ২১-২২ টাকা, আর এখন প্রতি রিয়ালের দাম বাংলাদেশি ৩০ টাকা। আমরা দাম বাড়ানো ছাড়াই এমনিতেই ব্যয় বেড়ে গেল এ কারণে। তারপরও আমরা চেষ্টা করব, যে করেই হোক, ব্যয় কম রাখার জন্য।’