ইসমাইল আলী: ভারত থেকে পরীক্ষামূলক আদানির বিদ্যুৎ আসা শুরু হয় গত ৮ মার্চ। প্রায় এক মাস পর ৬ এপ্রিল থেকে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে আদানি। পরীক্ষামূলক সময় সক্ষমতার পুরোটাই বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। ওই সময়ে প্রায় ১৮৭ কোটি টাকা বিল জমা দিলেও এখনও পরিশোধ করতে পারেনি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এছাড়া বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরুর পরও আরেকটি বিল জমা দিয়েছে আদানি। তবে সে বিল পরিশোধেও কোনো উপায় পাচ্ছে না পিডিবি।
সূত্র জানায়, পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরুর পর থেকে নিয়মিত ৭০০-৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আদানি। পরীক্ষামূলক উৎপাদনের সময়ে পিডিবির কাছে প্রায় সাড়ে ১৫ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে ভারতের এ কোম্পানিটি। এজন্য আদানি বিল জমা দেয়া প্রায় সাড়ে ১৭ মিলিয়ন ডলার বা ১৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটের বিদ্যুতের দাম পড়ে ১২ টাকার মতো (১১ দশমিক ৮৮ সেন্ট)। যদিও এ বিলের মধ্যে শুধুই কয়লার দাম ছিল। ক্যাপাসিটি চার্জ পরীক্ষামূলক সময়ের জন্য ধরা হয়নি।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ওই বিল জমা দেয়ার পর এলসি খোলার জন্য চেষ্টা করে পিডিবি। এজন্য প্রথমেই রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও একটি বিশেষায়িত ব্যাংককে চিঠি দেয়া হয়। তবে ডলার না থাকায় কেউই এলসি খোলায় রাজি হয়নি। এতে বহুজাতিক তিন ব্যাংক সিটি এনএ, এইচএসবিসি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডকে এলসি খোলায় অনুরোধ করে চিঠি দেয় পিডিবি। তবে ডলার সংকটে বিদেশি এ তিন ব্যাংকও সাড়া দেয়নি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বাধ্য হয়ে ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে চিঠি দেয় পিডিবি। বাংলাদেশে খোলা এলসি যেহেতু ভারত থেকে নিশ্চয়ন করাতে হবে, তাই ব্যাংকটিকে অনুরোধ করা হয় চিঠিতে। তবে ডলার না থাকায় তারাও পিডিবির প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এতে আদানির বিল পরিশোধ নিয়ে জটিলতায় পড়েছে পিডিবি। এরই মধ্যে বাণিজ্যিক উৎপাদনের শুরুর এক মাস পেরুনোর পর আরেক দফা বিল জমা দেয় আদানি।
যদিও বিলের পরিমাণ কত, তা বলতে রাজি হননি পিডিবির কর্মকর্তারা। তবে কোনো এলসি খোলায় কোনো ব্যাংক রাজি না হওয়ায় ডলার সংকটের সমাধান চেয়ে আদানির চিঠি বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠিয়ে দিয়েছে পিডিবি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা আদানির বিলের একটি খসড়া হিসাব শেয়ার বিজের কাছে তুলে ধরেন।
এতে দেখা যায়, বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর পর এপ্রিলে আদানির প্রায় ৩০ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। এতে প্রতি ইউনিট জ্বালানির দাম পড়েছে প্রায় আট টাকা ও ক্যাপাসিটি চার্জ পাঁচ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে আদানির খরচ ছিল এপ্রিলে ১৩ টাকা। এতে এপ্রিলের জন্য আদানির বিলের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৯০ কোটি টাকা বা ৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
এদিকে মে মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম আরও কমেছে। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে আদানির জ্বালানি ব্যয় পড়বে প্রায় ছয় টাকা। অর্থাৎ প্রতি
ইউনিটের দাম পড়বে ক্যাপাসিটি চার্জসহ ১১ টাকা। আর মে মাসে আদানি প্রায় ৪৭ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। এতে মে মাসের বিলের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫১৭ কোটি টাকা।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলেন, পরীক্ষামূলক সময়সহ মে পর্যন্ত এরই মধ্যে ১০ কোটি ডলারের ওপর (এক হাজার ৮৭ কোটি টাকা) বিল বাকি পড়েছে। তবে বর্তমানে কোনো ব্যাংকের পক্ষে এত বিশাল বিল পরিশোধ করা সম্ভব নয়। তাই বিদ্যুৎ বিভাগের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হবে। সরকারের বিশেষ অনুমোদন ছাড়া এ বিল পরিশোধ করা সম্ভব নয়।
এদিকে চুক্তি অনুযায়ী, বিল জমা দেয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তা পরিশোধ না করলে পিডিবিকে জরিমানা গুনতে হবে। তাই আদানির বিদ্যুৎ বিল নিয়ে বড় ধরনের জটিলতায় পড়েছে পিডিবি। যদিও এ বিষয়ে পিডিবি বা বিদ্যুৎ বিভাগের কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রসঙ্গত, ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় নির্মিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতা এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্রটি থেকে এক হাজার ৪৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ আসার কথা রয়েছে আগামী জুলাই থেকে। যদিও এরই মধ্যে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটটি পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেছে।
সূত্রমতে, কয়েকদিন দ্বিতীয় ইউনিট থেকে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহও করা হয়েছে বাংলাদেশকে। দ্রুতই দ্বিতীয় ইউনিটের সিওডি (বাণিজ্যিক উৎপাদন) হবে। তখন পূর্ণ ক্ষমতায় উৎপাদন করা হলে আদানির কেন্দ্রটি থেকে মাসে প্রায় ৯০ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। আর মে মাসের দর ধরলেও (প্রতি ইউনিট ১১ টাকা) মাসে আদানির বিল পরিশোধ করতে হবে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বা সোয়া ৯ কোটি ডলার।