Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 11:41 pm

ডলার সংকটে বন্ধের ঝুঁকিতে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি!

ডলার সংকট বেড়েই চলেছে। এতে শিল্পপণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলা যাচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্প উৎপাদন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিত্যপণ্যের আমদানিতে ডলার সংকট। জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ আমদানিতেও ডলার দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এ নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব

ইসমাইল আলী: ২০১৪ সালে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। সে সময় ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হয়। পরে তা আরও বাড়ানো হয়। বর্তমানে ভারত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। এজন্য মাসে বিল দিতে হয় প্রায় ৫২ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন ডলার। তবে ডলার সংকটে এ বিল পরিশোধে সংকট দেখা দিয়েছে। এতে ভারতের বিদ্যুৎ আমদানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

সূত্র জানায়, ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের দাম পড়ে ইউনিটপ্রতি ছয় থেকে সাড়ে ছয় টাকা। তবে এ বিদ্যুৎ বন্ধ হলে বিকল্প হিসেবে দেশীয় ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। ওইসব কেন্দ্রে ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়ে ১৪-১৮ টাকা। আবার ডলার সংকটে ফার্নেস অয়েল আমদানিও করা যাচ্ছে না। এতে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং বাড়াতে হবে।

যদিও ভারতের বিদ্যুৎ আমদানির বিল পরিশোধে নিয়মিত ডলার ছাড় করতে গত বছরই অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুরোধ করা হয়। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয় বিদ্যুৎ বিভাগে। পরে তা যায় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। তবে এতেও কোনো কাজ হয়নি।

পিডিবির তথ্যমতে, ২০১৪ সালে জিটুজি ভিত্তিতে ভারতের এনভিভিএনের (এনটিপিসি বিদ্যুৎ ভ্যাপার নিগম লিমিটেড) সঙ্গে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হয়। এ চুক্তির মেয়াদ ২৫ বছর। অর্থাৎ ২০৩৯ সালে এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। এ চুক্তির আওতায় মাসে সাড়ে ছয় মিলিয়ন ডলার বিল পরিশোধ করতে হয়। এইচএসবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে এ বিল পরিশোধ করতে হয়।

পরবর্তীতে এনভিভিএনের সঙ্গে আরও ৩০০ মেগওয়াট, পিটিসি ইন্ডিয়ার ২০০ ও সেম্বকর্প ইন্ডিয়ার ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হয় ২০১৮ সালে। এ তিন চুক্তির মেয়াদ ১৫ বছর। অর্থাৎ ২০৩৩ সালে এ তিন চুক্তি শেষ হবে। এ তিন চুক্তির আওতায় মাসে বিল দিতে হয় যথাক্রমে ১৫ মিলিয়ন ডলার, ১০ মিলিয়ন ডলার ও ১২ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। বাকি দুইটি বিল পরিশোধের চুক্তি রূপালী ব্যাংকের সঙ্গে।

এদিকে এনভিভিএনের সঙ্গে ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পৃথক চুক্তি করা হয়েছিল ২০১৬ সালে। পাঁচ বছর মেয়াদি এ চুক্তি শেষ হয় ২০২১ সালে। গত বছর সে চুক্তির মেয়াদ আরও পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন করা হয়, যা ২০২৬ সালে শেষ হবে। ওই চুক্তির জন্য মাসে সাত দশমিক ৬৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার চুক্তি সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে। এছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনার সঞ্চালন লাইন ব্যবহারের জন্য দেশটির পাওয়ার গ্রিড করপোরেশনকে মাসে দেড় মিলিয়ন ডলার দিতে হয়।

সূত্রমতে, সাত দশমিক ৬৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের জন্য গত মাসেই সোনালী ব্যাংকে অর্ডার প্লেস করে পিডিবি। তবে এখনও তা পরিশোধ করতে পারেনি সোনালী ব্যাংক। এতে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি বন্ধের ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে পিডিবির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিভিন্ন চুক্তির আওতায় ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুৎ বিল কয়েক মাস বকেয়া পড়েছে। এর মধ্যে এক মাসের বিল পরিশোধে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো অর্ডার দেয়া হয়েছে। বিলের টাকাও জমা দেয়া হয়েছে। তবে তারা ডলার দিতে না পারায় বন্ধ রয়েছে বিল পরিশোধ। এভাবে চলতে থাকলে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বন্ধ করে দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ভারতের বিল নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করলে তারা কিছুটা ছাড় (রিবেট) দিয়ে থাকে। তা তো সম্ভব হচ্ছেই না। উপরন্তু ভারতের বিদ্যুৎ না পেলে বিকল্প হিসেবে দেশীয় ফার্নেস অয়েলচাতিল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হবে। এগুলোর ব্যয় ভারত থেকে আমদানির দ্বিগুণ বা তারও

 বেশি। আবার ডলার সংকটে ফার্নেস অয়েল আমদানিও নিয়মিত করা যাচ্ছে না। ফলে সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।

এদিকে ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে না পারায় বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার মাত্র ২৭ দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে গেছে বাগেরহাটের রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। গত শনিবার (১৪ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ইন্ডিয়া পার্টনারশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ওই কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদনে যাওয়া নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়লা আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুমোদন দিতে দেরি করছে। বিআইএফপিসিএল ঋণপত্র খুলতে না পারার বিষয়টি চিঠি দিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও পিডিবি জানিয়েছে। ১০ ও ১১ জানুয়ারি বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফাও বৈঠক করেছেন। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। তবে কবে নাগাদ উৎপাদন স্বাভাবিক হবে তা বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। কয়লা না পাওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রটি চালু করার সুযোগ নেই বলে জানানো হয়।

একই ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে পায়রা কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও। বর্তমানে ওই কেন্দ্রটির মাত্র ১৫ দিনের কয়লা মজুত আছে। ডলার সংকটে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার বিল পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। এ-সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, ডলার সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা আমদানিতে যথেষ্ট ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ছিল না বিসিপিসিএলের। এজন্য তাদের চীনের অংশীদার হিসেবে সিএমসি ৬ মাস বিলম্বে বিল পরিশোধের শর্তে কয়লা সরবরাহে আগ্রহ প্রকাশ করে। ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল বিসিপিসিএল ও সিএমসির মধ্যে এ-সংক্রান্ত চুক্তিও সই হয়।

চুক্তির আওতায় সিএমসি ২৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭৪১ মেট্রিক টন কয়লা সরবরাহ করে, যার মূল্য ৪৭৭ দশমিক ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে গত ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত পুঞ্জীভূত বকেয়া দাঁড়িয়েছে ১১৬ দশমিক ১৪১ মিলিয়ন ডলার। এ অর্থ পরিশোধ না করলে সিএমসি নতুন করে কয়লা সরবরাহে অপারগতা প্রকাশ করেছে। এতে কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১১৬ দশমিক ১৪১ মিলিয়ন ডলার ছাড় করতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করতে বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে বিসিপিসিএল।

উল্লেখ্য, পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় গত ৯ জানুয়ারি সোনালী ব্যাংক ডলার চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দিয়েছিল। ওই চিঠিতে ২৪৮ মিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সহায়তা করেনি। এতে ১১ সংস্থার ২৬৮.৫৩৮ ডলার পরিশোধ আটকে আছে। এর মধ্যে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানিতে তিনটি বিলে ১২৬.৮১৬ মিলিয়ন এবং কয়লা পরিবহনের জাহাজ ভাড়া পরিশোধে পাঁচটি বিলে ৪.২৬৩ মিলিয়ন ডলার রয়েছে।