সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশে ব্যাংক খাতে ডলার সংকটে ভোগ্য ও শিল্প পণ্যের কাঁচামাল আমদানিপত্র (এলসি) খোলা সীমিত হয়েছে। এ কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে রড, সিমেন্ট, টাইলস, আটা, ময়দাসহ সব ধরনের ভোগ্য ও শিল্প পণ্যের দাম। মূলত আমদানি সুবিধা কমায় উৎপাদনকারীরা এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রয় করছেন। এতে বাজারের অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। বিপাকে পড়ছেন সাধারণ জনগণ। এলসি ও ডলার সংকট স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এ অস্থিরতা থাকবে বলে জানান আমদানিকারকরা।
আমদানিকারকরা বলেন, দেশে ব্যাংক খাতে কয়েক মাস ধরে ডলার সংকট চলছে। এ সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন রকমের আমদানি পণ্য আমদানিপত্র খোলার ক্ষেত্রে কঠোর নীতি অবলম্বন করছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক পণ্যের সঠিক দাম যাচাইয়ের কঠোরতা দেখাচ্ছে। এতে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আমদানিকারকদের ভোগান্তির কারণে এলসি খোলার হার আগের মাসের তুলনায় ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে। আবার কোনো কোনো ডলার সংকট বলে ব্যাংক সরাসরি এলসি নিচ্ছে না। এ কারণে অধিকাংশ গ্রাহক এলসির জন্য এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে ঘুরছেন। ফলে ভোগ্য ও শিল্প পণ্যের কাঁচামাল আমদানিপত্র খোলা সীমিত হয়েছে। এ কারণে প্রতিনিয়ত রড, সিমেন্ট, টাইলস, আটা, ময়দাসহ সব ধরনের ভোগ্য ও শিল্প পণ্যের দাম বাড়ছে। মূলত আমদানি সুবিধা কমায় উৎপাদকরা এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রয় করছেন।
বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, দুই সপ্তাহ ব্যবধানে আটা, ময়দার দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ। সয়াবিন তেলের লিটারপ্রতি দাম বেড়েছে ১২ টাকা। চিনি দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১৩ টাকা। একই সময়ে সিমেন্টের ব্যাগপ্রতি ২০ টাকা, রডের দাম টনপ্রতি চার হাজার টাকা, টাইলসের দাম প্রতিফুটে ২৫ টাকা পর্যন্ত বাড়ছে। এসব জিনিসের দাম বাড়ছে শুধু ডলার সংকটকে পুঁজি করে। মূলত আমদানি সুবিধা কমায় উৎপাদকরা এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে বিক্রয় করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির পরিমাণ কমতে শুরু করে। গত জুন মাসে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৮৪৪ কোটি ডলার, জুলাইতে তা কমে ৬৩৫ কোটি ডলারে নামে। আগস্টে এলসি খোলার পরিমাণ আরও কমে দাঁড়ায় ৬৩৩ কোটি ডলারে। আর সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে আরও কমে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭০ কোটি ডলারে। এক মাসের ব্যবধানে প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে এলসি খোলার হার।
অন্যদিকে জুলাই মাসে দেশে মোট আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৫৪৭ কোটি ডলার পণ্যের, যা জুন মাসের তুলনায় ৩১.৩২ শতাংশ কম। এদিকে অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্য আমদানি বেড়েছে ৫০.৯৯ শতাংশ। ভোগ্যপণ্য আমদানি বেড়েছে ৪.৫৬ শতাংশ। একইভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা ব্যাপকহারে কমেছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ৬০ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের এলসি খুলেছেন উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা; যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৫.৭৪ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে ১৭৭ কোটি ডলারের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছিল।
এদিকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলার হার কমেছে ১৪.৫৭ শতাংশ। এ ছাড়া মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ১৪.৫৬ শতাংশ। এ ৩ ধরনের পণ্যকে নতুন বিনিয়োগের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই এসব পণ্যের আমদানি কমাকে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগের জন্য বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমান অর্থনৈতিক নানামুখী চাপের মধ্যে কেউ নতুন উৎপাদনে যাচ্ছেন না। এ জন্যই মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে।
সেভেন রিংস সিমেন্টের কর্মকর্তা ইফতেকার হোসেন বলেন, আমদানিপত্র খোলা বন্ধ হওয়ায় আমাদের সিমেন্ট ব্যাগপ্রতি ২০ টাকা করে বাড়ানো হয়। আমাদের ৪৮০ টাকা ছিল। এখন নতুন দর ব্যাগপ্রতি ৫০০ টাকা। কিন্তু বাজারে তেমন বিক্রয় নেই। এভাবে হলে আমাদের প্রবৃদ্ধি মাইনাস হবে। এতে কর্মসংস্থান কমবে। যদিও সরকারি ও বেসরকারি খাতে নির্মাণকাজে গতি নেই। এসব কারণে শঙ্কায় আছি।
অন্যদিকে ইস্পাত খাতের একজন উদ্যোক্তা বলেন, এখন এলসি বন্ধ আছে। কিছুদিন আগে দেশের স্ক্যাব টনপ্রতি দর ছিল ৪৮ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এখন ৬০ হাজার টাকা। ফলে আমাদের রডের দামও বেড়েছে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা। যদিও বিক্রয় ৭০ শতাংশের বেশি কমেছে। কিন্তু পরিচলন ব্যয় তো কমেনি। এখন নতুন করে সব বিষয় নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। এলসিটা স্বাভাবিক করে দেয়া উচিত। চাহিদা না থাকলে এমনিতে এলসি খোলার হার কমে যাবে। এসব কথা বলে আরও আতঙ্ক ছড়ানো হয়।
এ বিষয়ে মসলা ও ড্রাই ফুডের আমদানিকারক অসীম এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার ও জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাবেক সভাপতি অসীম কুমার দাশ শেয়ার বিজকে বলেন, খাতুনগঞ্জ এলাকার ব্যাংকের শাখাগুলো অঘোষিতভাবে এলসি নেয়া বন্ধ করে রাখছে। এ কারণে আমাদের ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের অনেক আমদানিকারক বিপাকে পড়েছেন। আমাদের পেমেন্ট নিয়মিত আছে। অথচ বড় কিছু গ্রাহকের এলসি নেয়া হচ্ছে। এভাবে হলে তো বড়রা বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে। বড় আমদানিকারকরা চিনির মতো ভোগ্যপণ্যের দাম তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে। এতে বাজারের মনোপলি ব্যবসা শুরু হবে। আমরা যারা আমদানি করতে পারছি না, তাদের ব্যবসা পরিচালনায় লোকসান দিতে হবে। এ কারণে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ নানা কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমছে। একই সঙ্গে দেশে দেশে ভোক্তা মূল্যস্ফীতির কারণে ভোগ ব্যয় কমছে। ফলে ভোক্তার ভোগ ও চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানিকারক দেশ থেকে পণ্য বুকিং কমতে শুরু করেছে। আর সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনও কমছে। অথচ এখন আমদানিপত্র খোলা সঠিক সময়। কয়েক মাস পর আবার রমজান আসবে। কিন্তু ডলারের সংকটের কারণে আমরা আমদানি করতে পারছি না। আসলে ভুল সিদ্ধান্তর কারণে আমরা ব্যবসায়ী বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দেশে আমদানি কমলেও ডলার সংকট সহসাই কাটছে না। এ অবস্থায় বাজারে সংকট কাটাতে ডলার বিক্রিও বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রায় ৫০৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার।